রোগ

ধানের ব্লাস্ট রোগ ও তার প্রতিকার (ব্লাস্ট রোগের A to Z)

এ. কে. আজাদ ফাহিম

ধানের ব্লাস্ট রোগের অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ
ধানের ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত মারাত্মক ক্ষতিকারক রোগ। বোরো ও আমন মওসুমে সাধারণতঃ ব্লাস্ট রোগ হয়ে থাকে। অনুকুল আবহাওয়ায় এ রোগের আক্রমণে ফলন শতভাগ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। চারা অবস্থা থেকে শুরু করে ধান পাকার আগ পর্যন্ত যে কোন সময় রোগটি দেখা দিতে পারে। এটি ধানের পাতা, গিঁট এবং নেক বা শিষে আক্রমণ করে থাকে।

ধানের ব্লাস্ট রোগ চেনার উপায়ঃ

পাতা ব্লাস্টঃ
আক্রান্ত পাতায় প্রথমে ছোট ছোট কালচে বাদামি দাগ দেখা যায়। আস্তে আস্তে দাগগুলো বড় হয়ে মাঝখানটা ধূসর বা সাদা ও কিনারা বাদামি রং ধারণ করে। দাগগুলো একটু লম্বাটে হয় এবং দেখতে অনেকটা চোখের মত। একাধিক দাগ মিশে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পুরো পাতাটি শুকিয়ে মারা যেতে পারে।

গিঁট ব্লাস্টঃ
গিঁট আক্রান্ত হলে আক্রান্ত স্থান কালো ও দুর্বল হয়। জোরে বাতাসের ফলে আক্রান্ত স্থান ভেঙে যেতে পারে তবে একদম আলাদা হয়ে যায় না।

নেক বা শিষ ব্লাস্টঃ
শিশির বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সময় ধানের ডিগ পাতা ও শিষের গোড়ার সংযুক্ত স্থানে পানি জমে। ফলে উক্ত স্থানে বøাস্ট রোগের জীবাণু (স্পোর) আক্রমণ করে কালচে বাদামি দাগ তৈরী করে। পরবর্তীতে আক্রান্ত শিষের গোড়া পঁচে যাওয়ায় গাছের খাবার শিষে যেতে পারে না, ফলে শিষ শুকিয়ে দানা চিটা হয়ে যায়। দেরীতে আক্রান্ত শিষ ভেঙ্গে যেতে পারে। শিষের গোড়া ছাড়াও যে কোন স্থানে এ রোগের জীবাণু আক্রমণ করতে পারে।

ব্লাস্ট রোগ বিস্তারের অনুকুল পরিবেশঃ

  • দিনের বেলায় গরম (২৫-২৮০ সেন্টিগ্রেড) ও রাতে ঠান্ডা (২০-২২০ সেন্টিগ্রেড),
  • গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি,
  • ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘলা আকাশ,
  • অধিক আর্দ্রতা (৮৫% বা তার অধিক) এবং
  • ঝড়ো আবহাওয়া এ রোগের আক্রমণের জন্য খুবই অনুকুল।

রোগের বিস্তার যেভাবে ঘটেঃ

  • ব্লাস্ট রোগের জীবাণু প্রধানতঃ বাতাসের মাধ্যমে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দ্রæত ছড়ায়। আর যেখানেই অনুকুল পরিবেশ পায় সেখানেই জীবাণু গাছের উপর পড়ে রোগ সৃষ্টি করে।
  • ধানের খড়-কুটা এবং রেটুন ফসলের মধ্যে এ রোগের জীবাণু থাকতে পারে।
  • ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ১৮-৩২০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ৩ বছর পর্যন্ত মাঠে জীবিত থাকতে পারে এবং স্পোর তৈরী মাধ্যমে নতুন করে রোগও তৈরী করতে পারে।
  • বীজের মাধ্যমে ধানের চারায় রোগটি ছড়াতে পারে তবে তা পরিমাণে খুবই কম।

ধানের ব্লাস্ট রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়সমূহঃ


প্রাথমিক অবস্থায় নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ সহজে সনাক্ত করা যায় না। সাধারণ ভাবে যখন জমিতে নেক ব্লাস্ট রোগের উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়, তখন জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যায়। সে সময় অনুমোদিত মাত্রায় ঔষধ প্রয়োগ করলেও কার্যকরভাবে রোগ দমন করা সম্ভব হয় না। সেজন্য কৃষক ভাইদের আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

রোগ আক্রমণের পূর্বে করণীয়ঃ

  • জমিতে জৈব এবং রাসায়নিক সার সুষম মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। বিশেষতঃ ইউরিয়া সঠিক মাত্রায় তিন কিস্তিতে উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
  • পটাশ সার দুই ভাগে প্রয়োগ করতে হবে। ১ম ভাগ জমি তৈরীর সময় এবং ২য় ভাগ শেষ কিস্তির ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগের সময়।
  • সুস্থ এবং রোগমুক্ত ধানের জমি থেকে সংগৃহীত বীজ ব্যবহার করতে হবে।
  • একই জাতের ধান বিস্তৃর্ণ এলাকায় চাষ না করে বিভিন্ন জীবনকাল সম্পন্ন জাতের ধান আবাদ করা।
  • যেসব জমির ধান নেক ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়নি অথচ উক্ত এলাকায় রোগের অনুকুল আবহাওয়া (গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, কুয়াশাচ্ছান্ন মেঘলা আকাশ) বিরাজমান, সেখানকার ধানের জমিতে রোগ হোক বা না হোক, শিষ বের হওয়ার আগে আগেই প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে ৮ গ্রাম ট্রুপার ৭৫ডব্লিউপি/দিফা ৭৫ডব্লিউপি, অথবা ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ডব্লিউজি, অথবা ট্রাইসাইক্লাজল/স্ট্রবিন গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ১০ লিটার পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে শেষ বিকালে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।

রোগ আক্রমণের পরে করণীয়ঃ

  • ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় জমিতে পানি ধরে রাখতে পারলে এ রোগের ব্যাপকতা অনেকাংশে হ্রাস পায়।
  • পাতা ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে বিঘা প্রতি অতিরিক্ত ৫ কেজি পটাশ সার উপরি প্রয়োগ করতে হবে।
  • ব্লাস্ট রোগের প্রাথমিক অবস্থায় প্রতি ৫ শতাংশ জমিতে ৮ গ্রাম ট্রুপার ৭৫ডব্লিউপি/দিফা ৭৫ডব্লিউপি, অথবা ৬ গ্রাম নাটিভো ৭৫ডব্লিউজি, অথবা ট্রাইসাইক্লাজল/স্ট্রবিন গ্রুপের অনুমোদিত ছত্রাকনাশক অনুমোদিত মাত্রায় ১০ লিটার পানিতে ভালভাবে মিশিয়ে শেষ বিকালে ৫-৭ দিন অন্তর দু’বার প্রয়োগ করতে হবে।

তথ্যসূত্রঃ ‘ব্রি’ প্রকাশিত লিফলেট।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

রোগ

ধানের রোগ ও প্রতিকার

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মোট ৩২টি রোগ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় এবং বিভিন্ন জাতের ধানে শনাক্ত করেছে।