বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। কৃষির উৎকর্ষতা আজ তাই সময়ের দাবি। নিত্যনতুন লাগসই প্রযুক্তি ও কৃষি উপকরণসমূহের যথাযথ ব্যবহারই এনে দিতে পারে কৃষি ও কৃষকের কল্যাণ। কৃষি উপকরণের যথাযথ ব্যবহারের অভাবে ফসলের রোগ-বালাই ও পোকা-মাকড়ের আক্রমণ এবং পরিবেশগত বিপর্যয় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্রই কমবেশি সবজি উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশে উৎপাদিত সবজির মধ্যে বেগুন ও টমেটো খুবই জনপ্রিয় সবজি। বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা ও টমেটোর ফল ছিদ্রকারী পোকার আক্রমণে ফলন ও বাজার মূল্য মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। অন্যদিকে কুমড়া জাতীয় সবজির মাছি পোকা ও ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করে । সম্প্রতি পরিবেশ বান্ধব কৃষি প্রযুক্তি হিসেবে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদনে ফেরোমোন ফাঁদ নামে একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবিত হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে এ ফাঁদ যাদুর বাক্স হিসেবে পরিচিত।
যেসব পোকা দমনে ব্যবহারযোগ্যঃ বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা দমনে, টমোটোর ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনে এবং কুমড়া জাতীয় ফসলের (লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, ক্ষিরা, শসা, করলা, কাকরোল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, উচ্ছে, ধুন্দল, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি) মাছি পোকা দমনের জন্য এ ফাঁদ অত্যন্ত কার্যকরী।
পোকা দ্বারা ক্ষতির প্রকৃতিঃ কুমড়া জাতীয় ফসলে মাছিপোকা-
* এদের আক্রমণে প্রায় ৫০-৭০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যায়, যা কীটনাশক ব্যবহার করেও ভালভাবে দমন করা যায় না।
* প্রথমে ফলের ভেতরে ডিম পাড়ে, পরবর্তীতে ডিম থেকে কীড়া বের হয়ে ফলের ভেতরে খেয়ে নষ্ট করে ফেলে।
* মাছি পোকার কীড়া আক্রান্ত ফল দ্রæত পঁচে যায় এবং মাটিতে ঝড়ে পড়ে।
* লুকিয়ে থাকা পরিপূর্ণ কীড়া অল্প সময়েই পুত্তলি ও পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ পোকায় পরিণত হয়ে নতুন ভাবে আক্রমন শুরু করে। বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা-
* কীড়া কুঁড়ি, পাতার বোঁটা, কচি ডগা ইত্যাদি ছিদ্র করে খেতে খেতে ভেতরে ঢোকে সুড়ঙ্গ তৈরি করে। এতে কচি ডগা ঢলে পড়ে এবং অবশেষে মারা যায়।
* একইভাবে ফল ছিদ্র করে ভেতরে ঢোকে ও শাঁস খায়।
* পোকাক্রান্ত ফলের গায়ে ছিদ্র ও কীড়ার মল দেখা যায়।
* বেগুন কাটলে ভেতরে কীড়া ও পঁচা সুড়ঙ্গের চিহ্ন থাকে।
* বেশি আক্রান্ত বেগুন খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। টমেটোর ফল ছিদ্রকারী পোকা-
* ফলের ভেতর জলীয় গর্তে পোকার বিষ্ঠা, সুড়ঙ্গ ও পঁচা অংশ চোখে পড়ে।
* কীড়া প্রতিটি ফলের অংশবিশেষ ক্ষতি করে। ফল থেকে ফলে ঘুরে বেড়ায়।
* নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই ফল পেকে যায়।
* আক্রান্ত ফল সাধারনত বাজারজাত করা যায় না।
* ভেতরে বীজ খেয়ে ফসল ধ্বংস করে। পোকার আক্রমণের সময়ঃ ফুল আসার পূর্বেই এরা জমিতে আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়।
সেক্স ফেরোমোনের উপকারিতাঃ
১. সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তি।
২. কম খরচে কম সময়ে ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রন করা যায়।
৩. স্থানীয় উপকরণ দ্বারা ফাঁদ তৈরি করা যায়।
৪. এ প্রযুক্তির ব্যবহারে অধিক ফলন পাওয়া যায়।
সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ তৈরির উপকরনসমূহঃ
১. একটি ফাঁদ (কৃষক পর্যায়ে যাদুর বাক্স বলে)
২. সেক্স ফেরোমোন টোপ/লিউর/কিউ লিউর (কৃষক পর্যায়ে তাবিজ বলে)
৩. মাঠে স্থাপনের জন্য দু’টি খুঁটি
৪. পানি ও ডিটার্জেন্ট পাউডার বা সাবান
ফেরোমোন ফাঁদ তৈরি ও স্থাপন পদ্ধতিঃ
১. প্রায় তিন লিটার পানি ধারন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্লাস্টিকের বৈয়ম বা পাত্র নিতে হবে। বৈয়মের উভয় পাশে ৪-৫ ইঞ্চি উপরে ৪-৫ ইঞ্চি চওড়া করে ত্রিভূজাকারে কেটে নিতে হবে। বৈয়মের তলায় কাটা অংশের নিচে কমপক্ষে ২-৩ ইঞ্চি সাবান বা ডিটার্জেন্ট পাউডার মিশ্রিত পানি দিয়ে ভরে রাখতে হবে। অথবা বাজার থেকে তৈরি করা ফাঁদ ক্রয় করে ব্যবহার করতে হবে।
২. বৈয়মের ঢাকনার মধ্যখানে ছিদ্র করে তার বা সুতা দিয়ে টোপ বা তাবিজটি সাবান মিশ্রিত পানি হতে ২-৩ ইঞ্চি উপরে ঝুলিয়ে দিতে হবে। তবে বাজার থেকে ক্রয়কৃত বৈয়মের ঢাকনায় ছিদ্র করা থাকে সেখানে টোপ বা তাবিজটি ত্রিকোণাকারভাবে কর্তিত অংশের মাঝ বরাবর তার দিয়ে ঝুলিয়ে দিতে হবে।
৩. গাছের সম উচ্চতায় ফেরোমোন ফাঁদটি দু’টি খুঁটি দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে দিতে হবে।
৪. কর্তিত অংশ উত্তর-দক্ষিণ মুখ করে ঝুলাতে হবে। ফেরোমোন ফাঁদ মাঠে স্থাপনের সময়ঃ চারা লাগানোর ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে জমিতে ফাঁদ লাগাতে হবে।
প্রয়োগ মাত্রাঃ
১. জমিতে ১০-১২ মিটার পর পর বর্গাকারে ফেরোমোন ফাঁদ স্থাপন করতে হবে।
২. প্রতি ২.৫ শতাংশ জমির জন্য ১ টি ফাঁদ ব্যবহার করতে হবে।
৩. একটি টোপ বা তাবিজ ২ মাস পর্যন্ত কার্যকরী থাকে।
সাবধানতা
১. সাবান পানি বা বৃষ্টির পানিতে টোপ বা তাবিজটি ভিজে গেলে তা পরিবর্তন করতে হবে।
২. প্যাকেট কাটা হলে প্যাকেটে থাকা সব টোপ বা তাবিজ ব্যবহার করতে হবে।
৩. ৩-৫ দিন পর পর সাবান মিশ্রিত পানি পরিবর্তন করতে হবে।
৪. সপ্তাহে কমপক্ষে ২ দিন ফাঁদের পানি পরীক্ষা করে মরে থাকা পোকা পানি থেকে আঙ্গুল অথবা কাঠি দিয়ে সরিয়ে ফেলতে হবে।
৫. গাছের বৃদ্ধির সাথে ফাঁদটিকেও ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে তুলে দিতে হবে।
Powered by Facebook Comments