জীবনধারা

রাঙ্গামাটির বনরুপা বাজার ও সমতা ঘাটের ভাসমান বাজারের গল্প

রাঙামাটি থেকে ফিরে এ. কে. আজাদ ফাহিম

হ্রদ-পাহাড়ের শহর রাঙামাটি তার সৌন্দর্য ও রূপের কারণে বিখ্যাত। সুবিশাল সবুজ পাহাড় আর কাপ্তাই হ্রদে ঘেরা এই জনপদ সবার কাছে পরিচিত অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে। পাশাপাশি এখানকার ব্যতিক্রম জীবনযাত্রা রাঙামাটির পাহাড়ি জীবনকে করেছে স্বতন্ত্র।

পাহাড়ি বাজার বনরুপা বাজার। কী নেই এই বাজারে? এই জায়গায় বিক্রি হচ্ছে ফলমূল বা শাকসবজি তার পাশেই পাওয়া যায় ভ্রাম্যমাণ পাহাড়ি পোশাকের দোকান, হয়তো তার পাশেই পসরা সাজিয়েছেন ওষুধ কিংবা প্রসাধনী বিক্রেতা। বাজারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবন চালানোর প্রায় সবকটি উপাদানে পরিপূর্ণ থাকে এই পাহাড়ি বাজারটি। পাহাড়ে বসবাসরত সব জনগোষ্ঠীদের উপস্থিতিতে সরব এই বাজার। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, পাহাড়ি, বাঙালি সকল জনগোষ্ঠীর মিলনমেলায় এই বাজার যেন সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

বনরুপা রাঙামাটি শহরের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ বাজারগুলোর একটি। কাইন্দ্যা, বন্দুকভাঙ্গা, বালুখালী, বসন্তপাড়া, মাইসছড়ি, নতুনপাড়া, কিল্লামুড়া, নানিয়ারচর, বুড়িঘাটসহ আরও অনেক পাহাড়ি গ্রাম থেকে জুমের উৎপাদিত ফসল নিয়ে আসেন পাহাড়িরা। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজন বিশেষ ঝুড়ি ব্যবহার করে এসব পণ্য পিঠে বহন করে বাজারে নিয়ে আসেন। সপ্তাহের ৭ দিন খোলা থাকলেও প্রতি শনি ও বুধবার এখানে হাট বসে। তবে স্থানীয়রা এটিকে হাট না বলে বলেন ‘বাজার বার’।


বাজার বারেই লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে বনরূপা। বাজারের একদম শেষ প্রান্তে আছে ‘সমতা ঘাট’ নামে একটি নৌ-ঘাট। এই নৌ-ঘাটটিই এই বাজারের প্রাণ। পাহাড়ে উৎপাদিত ফলমূল, শাকসবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস সবকিছুই বোটে করে আনা হয় এই ঘাটে। এই ঘাট থেকেই সেগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় বাজারে।
বাজার বারের দিনগুলোতে দেখা যায়, ভোর থেকেই ইঞ্জিনচালিত নৌকা করে নিজেদের উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল নিয়ে ঘাটে ভিড়তে শুরু করেন পাহাড়ি নারী-পুরুষরা। শাকসবজির পাশাপাশি কাপ্তাই হ্রদ থেকে আহরণ করা হরেকরকম মাছের পসরা সাজান বিক্রেতারা। বাজার বারে কাপ্তাই হ্রদের তাজা মাছ পাওয়া যায়। লেকের চাপিলা, কাচকি, মলা, টেঙরা, বাইন, বাইলা, রুই, তেলাপিয়াসহ আরও বিভিন্ন রকমের মাছ রয়েছে বাজারে। মাছ-মাংসের পাশাপাশি বিক্রি হয় শামুক। এটি পাহাড়িদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার। বনরুপা বাজারেই একমাত্র পাওয়া যায় বন্য শূকরের মাংস। পাশাপাশি খামারে চাষ করা শূকর, ব্যাঙ, কুইচ্চা, সাপসহ নানান প্রাণীর মাংস।
বোটে করে হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন প্রাণী।

এ বাজারে বিক্রি হওয়া পাহাড়ি সবজির মধ্যে, বাঁশকোড়ল, পুজক বিচি, তাঁরা, আমিল্য পাদা (টক পাতা), জুম কুমড়া, জুমের বেগুন, জুমকচু, তিত বেগুন, ঠান্ডা আলু, থানকুনি পাতা, হলুদ ফুল, কচু শাক, ধাইন্যা মরিচ, আদা, হলুদ, ঢেঁকি শাক, কলার মোচা অন্যতম। এসব সবজির বেশিরভাগই বনে জন্ম নেওয়া আবার কিছু জুমের খেতে উৎপাদিত। এছাড়া ড্রাগন ফল, পাহাড়ি মাল্টা, জলপাই, তেঁতুল, পেঁপেসহ নানান পদের ফলমূলের সমারোহ চোখে পড়ে। পাহাড়ে বিপুল পরিমাণ কলা উৎপাদন হওয়াতে বাজারে আলাদা করে কলার বাজার বসে। বিভিন্ন কলার মধ্যে বাংলা কলাই বেশি পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে গরুর দুধ বোতল করে এনে বিক্রি করা হয়। পাহাড়িদের গরুর দুধের বেশ সুনাম। তাই বিক্রিও হয় ভালো। বাঁশে মধ্যে দইও বিক্রি হয় এই বাজারে।

এছাড়াও আছে শুকনো মাছ, নাপ্পি, সিদল, মহিষের চামড়াসহ নানান পাহাড়ি খাবার। ‘নাপ্পি’ পাহাড়িদের পছন্দের খাবারের একটি। এটি তরকারির স্বাদ বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। এসবের পাশাপাশি রয়েছে নানান পদের শুটকি ও মুদি দোকান। জুমে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের চালও পাওয়া যায় বাজারে। পান সুপারি তামাক জর্দা সাদাপাতাসহ ধুমপায়ীদের জন্যও রয়েছে বিশাল আয়োজন। পাহাড়িদের মধ্য হুক্কা সেবীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। তাই বাঁশ দিয়ে বানানো হুক্কার পাত্র বিক্রির দোকানও যেমন আছে আবার তামাক দিয়ে বানানো হুক্কা খাওয়ার উপকরণের প্রাপ্যতাও রয়েছে বাজারে।

পার্বত্য জনপদের এই ঐতিহ্যবাহী বাজারটি দেশেবিদেশে পরিচিত হয়ে উঠুক এমনটাই আশা করেন এখানকার ক্রেতা-বিক্রেতারা।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

জীবনধারা

সিয়াম সাধনার মাসে সুস্থ থাকতে কিছু করণীয় ও বর্জনীয়

রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতের সওগাত নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত পবিত্র মাহে রমজান। এই সময়ে আমাদের নিয়মিত জীবন–যাপনে কিছু পরিবর্তন আসে
জীবনধারা

ইসলামের দৃষ্টিতে কৃষি ভাবনা – শাহ পারভেজ

পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম আ: থেকে শুরু হয়ে পৃথিবীতে আজ মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটির বেশি। প্রাণীর সংখ্যা অগণিত।এই