‘লাকস্ফাদ কানা লাকুম ফি রাসুলিল্লাহি উসওয়াতুন হাসানাহ।’ অর্থাৎ তোমাদের জন্য রাসুলের (সা.) জীবনেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ (৩৩ :২১)। অপর আয়াতে আল্লাহপাক বলেন- ‘ইন্নি রাসুলুল্লাহি ইলাইকুম জামিআ।’ অর্থাৎ নিশ্চয় আমি তোমাদের সবার জন্য আল্লাহর রাসুল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি (৭ :১৫৮)। তাই মানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সব মানুষের নবী, বিশ্বনবী। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায়, দেশ-কাল নির্বিশেষে তিনি হলেন সব মানুষের জন্য মহান আল্লাহ প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ; যিনি বিশ্বমানবতার জন্য সর্বোত্তম আদর্শের প্রতীকও বটে। মানবজীবনের সব দিক ও বিভাগে যাঁকে অনুসরণ করলে মহান আল্লাহতায়ালার নৈকট্য ও ভালোবাসা অর্জিত হবে, তিনি হলেন সেই সর্বোত্তম আদর্শের নমুনা বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)। ইরশাদ হচ্ছে- ‘কুল ইন কুনতুম তুহিব্বুনাল্লাহা ফাত্তাবিউনি য়ুহবিব কুমুল্লাহ।’ অর্থাৎ হে রাসুল, আপনি বলে দিন, তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা চাও তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, তবেই আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন (৩ :৩১)। সৃষ্টিজগতের সবার জন্য অনুসরণীয় এই মহামানবের সব আদেশ-নিষেধ মহাসত্যে বিশ্বাসীদের অবশ্যপালনীয় বিষয় হিসেবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহপাক বলে দিয়েছেন- ‘মা আতাকুমুর রাসুলু ফাখুযুহু ওয়া নাহাকুম আনহু ফানতাহু।’ অর্থাৎ তোমাদের রাসুল যা নিয়ে এসেছেন তা আঁকড়ে ধরো, আর যা করতে নিষেধ করেছেন তা থেকে বিরত থেকো (৫৯ :৭)।
মহান আল্লাহর কাছে সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেন রহমতের প্রতীক, করুণার আধার বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)। আর তাই জগদ্বাসীকে আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় হাবিবের সর্বোন্নত গুণের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন- ‘ওয়ামা আরসালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন।’ অর্থাৎ হে নবী, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য করুণার প্রতীক হিসেবে প্রেরণ করেছি। বিশ্বজগতের রহমত হিসেবে প্রেরিত এই মহামানবের অপর গুণটি হলো তাঁর সর্বোৎকৃষ্ট চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে মহান স্রষ্টার ঘোষণা নিম্নরূপ- ‘ওয়া ইন্নাকা লাআলা খুলুকুল আযিম।’ অর্থাৎ হে রাসুল, আপনি সর্বোন্নত চারিত্রিক মাধুর্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত আছেন (৬৮:৪)।
উল্লিখিত আয়াতগুলোর ভিত্তিতে আমরা রাসুলের (সা.) যেসব গুণ ও বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাই তা হলো- সর্বোত্তম আদর্শ, অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব, গোটা বিশ্বের সবার জন্য তিনি রাসুল, আল্লাহর ভালোবাসাপ্রাপ্তির মাধ্যম, তাঁর আদেশ-নিষেধের বাধ্যবাধকতা, বিশ্বের রহমত এবং সর্বোৎকৃষ্ট নৈতিক ও চারিত্রিক অবস্থান। এমন একজন মহামানবকে আল্লাহপাক তাঁর তাওহিদ বা একত্ববাদের দাওয়াত প্রদানের নিমিত্তে নির্বাচিত করেছেন, যেটি নিঃসন্দেহে মহান আল্লাহর সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নির্বাচন।
মহানবীর (সা.) ঘোষণা- ‘ইন্নামা বুইসতু মুআল্লিমান।’ অর্থাৎ আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে মানবতার শিক্ষক হিসেবে। বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষক হয়ে রাসুলের (সা.) আবির্ভাব ঘটল। মমতায় ভরপুর হৃদয় দিয়ে আদর্শ শিক্ষকের ভূমিকায় বিপদগ্রস্ত মানবতার প্রকৃত সমস্যা তিনি উপলব্ধি করলেন এবং নিজের মাঝে বিকশিত অপূর্ব গুণাবলি আর অপরিসীম দরদ দ্বারা মানবজীবনের স্থানচ্যুত লক্ষ্যকে সঠিক স্থানে স্থাপন করলেন। আইয়ামে জাহেলিয়াকে স্বর্ণযুগে পরিণত করলেন। ইতিহাসের ধারাকেই তিনি পরিবর্তন করে দিলেন। ২৩ বছরের ব্যবধানে তিনি পৃথিবীর গতিপথকেই পাল্টে দিলেন। সভ্যতা-মানবতা তাঁর কাছে এতটাই ঋণী যে, যদি তাঁর প্রদত্ত অনুগ্রহ ও অবদান ফিরিয়ে নেওয়া হয়, তবে মানব সভ্যতা হাজার হাজার বছর পিছিয়ে যাবে আর বিশ্বমানবতা হারাবে তার সবচেয়ে প্রিয় বস্তু এবং পৃথিবীতে জীবনবোধ বলতে কিছু আর থাকবে না। তাঁর পরশে জন্ম নিল এমন এক দল সৎকর্মশীল ব্যক্তি, যাঁদের একমাত্র পরিচয় ছিল আল্লাহর খাঁটি বান্দা হিসেবে। তাঁরা অশান্ত ও অভিশপ্ত জনপদকে এল্ম ও এয়াকিন, ন্যায় ও নিরাপত্তা, শান্তি ও শৃঙ্খলা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর জিকিরে পরিপূর্ণ করে দিল। মহান আল্লাহপাক তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পুণ্যবান সেসব মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইরশাদ হচ্ছে- ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহি ওয়াল্লাজিনা মাআহু আশিদ্দাউ আলাল কোফ্ফারি রুহামাউ বাইনাহুম।’ অর্থাৎ মুহাম্মদ (সা.) হলেন আল্লাহর রাসুল আর তাঁর সঙ্গে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা কাফেরদের প্রতি অত্যন্ত কঠোর; কিন্তু নিজেরা পরস্পর খুবই রহমশীল (৪৮:২৯)।
মহানবীর (সা.) পবিত্র সান্নিধ্য তাঁদেরকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত করল। স্বয়ং রাব্বুল আলামিন তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন। তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল পবিত্র কোরআনের বাণীর মধ্য দিয়ে- ‘রাদিয়াল্লাহু আনহুম ওয়ারাদু আনহু।’ অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা তাঁদের (সাহাবি) প্রতি সন্তুষ্ট এবং তাঁরাও আল্লাহ পাকের ওপর সন্তুষ্ট (৯৮ :৮)।
আল্লাহর নবীর নক্ষত্রতুল্য সাহাবিদের মাধ্যমে জমানার রথ বদলে গেল। আর এসবই হলো সর্বোত্তম আদর্শ নিয়ে মহানবীর (সা.) শুভাগমনের ফলস্বরূপ। মহানবীর (সা.) জন্মের সময় এবং অব্যবহিত পূর্বে বেশ কিছু বিস্ময়কর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। মহানবীর (সা.) শৈশব-কৈশোরের ঘটনা আমরা জানি। কৈশোরে তার এক ধ্বংসোন্মুখ জাতিকে অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রাণের এক সফল প্রচেষ্টার নাম ছিল সেই হিলফুল ফুযুল। সুতরাং মহানবী (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ যুবক তথা পৃথিবীর সব যুবকের জন্য আদর্শ।
মহানবীর (সা.) একাধিক বিয়ের সমালোচনায় অনেককে মুখর হতে দেখি। কিন্তু কোনো একজন সমালোচক আজ অবধি বলতে পারেননি যে রাসুলের কোনো একজন সহধর্মিণী তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন বা রাসুল (সা.) কোনো স্ত্রীর প্রতি অবিচার করেছেন। বরং ইতিহাসে এ বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে, রাসুলের (সা.) সব সহধর্মিণীই তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন এবং রাসুল (সা.) নিজেও সবার প্রতি ইনসাফপূর্ণ আচরণ করেছেন। বস্তুত মহানবী (সা.) ছিলেন একজন আদর্শ স্বামী এবং পৃথিবীর সব স্বামীর জন্য তিনি আদর্শ। তিনি বলেছেন- ‘তোমাদের কাছে সে ব্যক্তিই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম আর আমি আমার সব স্ত্রীর কাছে উত্তম ব্যক্তি।’
মহানবী (সা.) বলেছেন- ‘ফাতেমা আমার কলিজার টুকরা, নয়নের মণি। যে ব্যক্তি ফাতেমাকে কষ্ট দিল সে যেন আমাকেই কষ্ট দিল। আর যে ফাতেমাকে সন্তুষ্ট করল সে যেন আমাকেই সন্তুষ্ট করল।’ স্বীয় সন্তান সম্পর্কে রাসুলের (সা.) উল্লিখিত উক্তির পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই তাঁর পিতৃত্বের মমতা উপলব্ধি করা যায়। আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যারা মেয়ের বাবাকে বিভিন্ন নেতিবাচক শব্দ প্রয়োগে গালি দিয়ে থাকে। মহানবী (সা.) তাঁদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন- ‘তোমরা মেয়েসন্তানের বাবাকে বকা দিও না। কেননা, আমি নিজেই মেয়েদের পিতা।’ উল্লেখ্য, রাসুল (সা.) চারজন মেয়ে সন্তানের পিতা।
লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যেঃ সমকাল।
Powered by Facebook Comments