সিলেটি ভাষায় কথা বলতে যারা লজ্জা পায়
তাদের এই লেখাটা পড়া উচিত।
আমাদের আশে পাশেই এমন লোক আছে যারা সিলটিকথায়মাতলেসরমপাইনফুটানিদেখাইয়াশুদ্ধমারইন🤓
একটা মজার গল্প দিয়ে শুরু করি। ক্লাস টেনের বাংলা পাঠ্যবইয়ে অনেকেই হয়তো “রসগোল্লা” রম্যগল্পটি পড়েছেন, গল্পটির রচয়িতা বিখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী, তিনি বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার সন্তান। স্বাভাবিকভাবেই সিলেটী ভাষায় কথা বলতেন। খেয়াল করলে দেখবেন আমরা যারা সিলেটী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত তারা প্রমিত বাংলায় কথা বলার সময়ও সিলেটী একটা ফ্লেভার থেকেই যায়, উনারও তাই ছিলো। তিনি রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভের জন্য এতদ অঞ্চলের প্রথম দিককার ছাত্র হিসেবে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীতে ভর্তি হন। উনাকে রবীন্দ্রনাথ অনেক স্নেহ করতেন, তাঁর মুখের ভাষা শুনে কবিগুরু ক্লাস নিতে এসে একদিন হাসিমুখে বলেই ফেললেন যে আলীর মুখের ভাষা কমলালেবুর মিষ্টি সুগন্ধের মতোই। যেখানে খোদ রবীন্দ্রনাথ ই সিলেটী ভাষাকে এত সুন্দর উপমা দিয়েছেন সেখানে অন্য কেউ এ ভাষা নিয়ে কি বললো সেটা দেখার বা শোনার আবশ্যকতা নেই।
প্রথমেই বলে রাখি, সিলেটী ভাষা আর বাংলা ভাষা কিন্তু একই ভাষা না, কিংবা সিলেটী ভাষা বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপও না, এটা সম্পূর্ণ স্বাধীন আরেকটি ভাষা। জাতিসংঘ স্বীকৃত ৩,০০০ টি পূর্ণাঙ্গ ভাষার মধ্যে নাগরী বর্ণের সিলেটী (Siloti – ꠡꠤꠟꠐꠤ) ভাষাও একটি।
বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এবং ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় প্রচলিত একটি ইন্দো-আর্য ভাষা । এছাড়াও ভারতের মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মণিপুর রাজ্যের কিছু অংশে ভাষাটি কথিত হয়। সিলেটি ভাষা শুধু ভারত বা বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, ক্রমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চল এবং ভারত ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ভাষা ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাত লক্ষেরও বেশী। বৃহত্তর সিলেটের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি। লন্ডনের সিলেটি রিসার্চ এন্ড ট্রেন্সলেশন সেন্টারের উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, সিলেট অঞ্চল সহ সমগ্র বিশ্বে বর্তমানে এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষের মুখের ভাষা হচ্ছে সিলেটি।
সিলেটী ভাষাকে প্রথমে নাগরী বর্ণে লিখিত রূপ দেয়া হয়। নদীয়া ভিত্তিক প্রমিত বাংলা ভাষার মূল রীতির সাথে এর যথেষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। নাগরী বর্ণে সর্বপ্রাচীন খোঁজ পাওয়া পাণ্ডুলিপিটি আনুমানিক ১৫৪৯ থেকে ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে লেখা। সিলেটী নাগরী সৃষ্টির আগে ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভুত “দেব-নাগরী” লিপি এ অঞ্চলের উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশের (পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বাদে) লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভুত, আর এমন ধারনা প্রচলিত আছে যে ব্রাহ্মী লিপি স্বয়ং ব্রহ্মার পক্ষ থেকে দেওয়া। তাই গবেষকদের মতে, ইসলাম প্রচারক সুফী দরবেশরা এবং তখনকার সময়ের মুসলিম লেখকরা নিজেদের ধর্মীয় অনুভুতির সমন্বয়ে আরবি ও ফারসি হরফকে নিজেদের হরফ ধরে নিয়ে আলাদা একটি লিপি তৈরি করে নেন, এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয় নাগরী লিপির, স্থান পায় সাধারণ মানুষের হৃদয়ে।
সিলেটি নাগরী লিপিতে ৩৩টি হরফ বা বর্ণ রয়েছে। এর মধ্যে স্বরবর্ণ ৫টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি, অযোগবাহবর্ণ বা ধ্বনিনির্দেশক চিহ্ন ১টি।
এই ভাষার ইতিহাসও সুপ্রাচীন। সিলেটি ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ ভাষার প্রচলন শুধু সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয়ের বহু সংখ্যক লোকের মুখের ভাষা সিলেটী। এটি একটি প্রাচীন ভাষা তাতে কোন সন্দেহ নেই। গবেষক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর মতে জটিল সংস্কৃত-প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে ‘সিলটী নাগরী’ লিপির উদ্ভাবন হয়েছিল খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। অপ্রচলিত এই লিপিতে একসময় সিলেট অঞ্চলে রচিত হয়েছে অনেক মূল্যবান সাহিত্য। জটিল সংস্কৃত প্রধান বাংলা বর্ণমালার বিকল্প লিপি হিসেবে সেসময় নাগরী লিপির উদ্ভব ঘটেছিলো। লিপিটি এতটাই সহজ জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, মাত্র আড়াই দিনে তা শেখা যেত বলে সিলেটী প্রবাদে আছে – ‘আড়াই দিনে নাগরী হিকা যায়’।
একসময় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল প্রধানত সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত ছিলো এ লিপির সাহিত্য। তবে সিলেট ছাড়াও কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ভৈরব, আসাম, করিমগঞ্জ ও শিলচরে এর ব্যবহার ছিলো। নাগরী লিপিতে রচিত অনেক সাহিত্যরত্ন উদ্ধার ও প্রকাশ করেছে ঢাকার ‘উৎস প্রকাশনী’।
এখন আসি মুল কথায়। সিলেটী ভাষা যে বাংলা ভাষার আঞ্চলিকতা না বরং সম্পূর্ণ স্বাধীন আরেকটা ভাষা সেটা উপরেই সংক্ষেপে বর্ণনা করা আছে। সব ভাষাই যেহেতু তার আপন স্বকীয়তায় টিকে থাকার অধিকার রাখে তাই সিলেটী ভাষাও নিজ স্বকীয়তায় টিকে থাকুক এটাই চাই। আজকাল কাগজে লেখার চেয়ে যেহেতু কীবোর্ডে বেশি লেখালেখি চলে তাই এন্ড্রোয়েড কীবোর্ড হিসেবে গুগল প্লে স্টোরে syloti nagri keyboard পাওয়া যাচ্ছে, এমনকি বাংলা থেকে নাগরী কনভার্টারও। সেখান থেকে আমরা সহজেই নাগরী বর্ণে সিলেটী ভাষার লেখ্যরূপ আয়ত্ব করতে পারি। শহীদের রক্তে লেখা আমাদের রাস্ট্রভাষা প্রিয় বাংলাকে বুকে ধারণ করার পাশাপাশি সিলেটী ভাষার চর্চার মাধ্যমেও আমরা বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারি শেঁকড়ের এই ভাষারীতিটাকে, সমৃদ্ধ করতে পারি সকল মায়ের মুখের ভাষার পুষ্পিত পথচলাকে।
সংগৃহিত।
Powered by Facebook Comments