পুষ্টিমূল্য ও ভেষজগুণঃ
সূর্যমুখীর বীজে ৪০-৪৫% লিনোলিক এসিড রয়েছে, তাছাড়া এতেলে ক্ষতিকারক ইরোসিক এসিড নেই। হৃদরোগীদের জন্য সূর্যমুখীর তেল খুবই উপকারী।
ব্যবহারঃ সূর্যমুখীর খৈল গরু ও মহিষের উৎকৃষ্টমানের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর বীজ ছাড়ানোর পর মাথাগুলো গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। গাছ ও পুষ্পস্তবক জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
উপযুক্ত জমি ও মাটিঃ সূর্যমুখী সাধারণত সব মাটিতেই জন্মে। তবে দো-আঁশ মাটি সবচেয়ে বেশী উপযোগী।
জাত পরিচিতিঃ এ পর্যন্ত বারি কর্তৃক ২টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। যথা (১) কিরণী (ডিএস-১) এবং বারি সুর্যমুখী-২।
কিরণীঃ ১৯৯২ সালে জাতটির অনুমোদন দেয়া হয়। বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতটি উদ্ভাবন করা হয়। জাতটির কান্ডের ব্যাস ১.৫-২.০ সে.মি.। পরিপক্ক পুষ্পমঞ্জুরী বা শাখার ব্যাস ১২-১৫ সে.মি.। প্রতি মাথায় বীজের সংখ্যা ৪০০-৬০০। বীজের রং কালো। ১০০০ বীজের ওজন ৬৮-৭২ গ্রাম। বীজে তেলের পরিমাণ শতকরা ৪২-৪৪ ভাগ। জাতটি মোটামুটি অলটারনারিয়া রোগ সহনশীল। জীবনকাল ৯০-১১০ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন ১.৬ হতে ১.৮ টন।
বারি সূর্যমুখী-২: গাছের কান্ডের ব্যাস ২.০-২.৪ সে.মি.। পরিপক্ক পুষ্পমঞ্জুরী বা শাখার ব্যাস ১৫-১৮ সে.মি.। বীজের রং কালো। ১০০০ বীজের ওজন ৬৫-৭০ গ্রাম। প্রতি মাথায় বীজের সংখ্যা ৪৫০-৬৫০। তেলের পরিমাণ শতকরা ৪২-৪৪ ভাগ। জীবনকাল রবি মৌসুমে ৯৫-১০০ দিন এবং খরিফ মৌসুমে ৯০-৯৫ দিন। হেক্টর প্রতি ফলন রবি মৌসুমে ২.০ হতে ২.৩ টন এবং খরিপ মৌসুমে ১.৫ হতে ১.৮ টন।
বোনার সময়ঃ
সূর্যমুখী সারা বছর চাষ করা যায়। তবে অগ্রহায়ন মাসে চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। দেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলে তাপমাত্রা ১৫ সেন্টিগ্রেড এর নিচে হলে ১০-১২ দিন পরে বীজ বপন করা উচিত। খরিফ-১ মৌসুমে জৈষ্ঠ্য (মধ্য এপ্রিল থেকে মধ্য মে) মাসেও এর চাষ করা যায়।
বপন পদ্ধতি ও বীজের হারঃ
সূর্যমুখী বীজ সারিতে বুনতে হয়। সারি থেকে সারির দূরত্ব ৫০ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ২৫ সেন্টিমিটার। এভাবে বুনলে প্রতি হেক্টরে (২৪৭ শতকে) ৮-১০ কেজি বীজ লাগে। বারি সূর্যমূখী-২ এর জন্য হেক্টর প্রতি ১২-১৫ কেজি বীজের দরকার হয়।
সার ব্যবস্থাপনাঃ ভালো ফলনের জন্য সূর্যমুখীতে নিম্নরূপ সার ব্যবহার করতে হবে।
সারের নাম
সারের পরিমাণ/হেক্টর।
ইউরিয়া ১৮০-২০০ কেজি
টিএসপি ১৫০-২০০ কেজি
এমওপি ১২০-১৫০ কেজি
জিপসাম ১২০-১৭০ কেজি
জিংক সালফেট ৮-১০ কেজি
বরিক এসিড ১০-১২ কেজি
ম্যাগনেসিয়াম সালফেট ৮০-১০০ কেজি
সার প্রয়োগ পদ্ধতিঃ
অর্ধেক ইউরিয়া এবং বাকি সব সার শেষ চাষের সময় জমিতে ছিটিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে হবে। বাকি অর্ধেক ইউরিয়া ২ ভাগ করে প্রথম ভাগ চারা গজানোর ২০-২৫ দিন এবং দ্বিতীয় ভাগ ৪০-৪৫ দিন পর (ফুল ফোটার পূর্বে) প্রয়োগ করতে হবে।
পোকামাকড় ব্যবস্থাপনাঃ
পোকার নামঃ
বিছা পোকা ছোট অবস্থায় এরা দলবদ্ধভাবে থাকে। কীড়া বা বিছা হলুদ রংয়ের এবং গায়ে কাঁটা থাকে। এরা সাধারণত গাছের পাতায় আক্রমণ করে। এ পোকার কীড়া দলবদ্ধভাবে থেকে পাতার সবুজ অংশ খেয়ে পাতাকে পাতলা সাদা পর্দার মতো করে ফেলে।
ব্যবস্থাপনাঃ সহ পোকা দেখার সংগে সংগে গাছ থেকে পোকাসহ পাতা সংগ্রহ করে পোকা মেরে ফেলতে হবে। সেচ নালায় কেরোসিন মিশ্রিত পানি থাকলে কীড়া পানিতে পড়ে মারা যায়। আক্রমণ বেশি হলে নাইট্রো (সাইপরমেথ্রিন+ ক্লোরোপাইরিপস) ২০ ইসি ২ মিলিলিটার প্রতি লিটার পানিতে আক্রান্ত ক্ষতে ১০ দিন পর পর ২ বার ছিটিয়ে পোকা দমন করা যায়।
রোগের নামঃ
পাতা ঝলসানো রোগ
ক্ষতির নমুনাঃ অলটারনেরিয়াহেলিয়ানথী নামক ছত্রাকের সাহায্যে এ রোগ ছড়ায়। আক্রমণের শুরুতে পাতায় ধুসর বা গাঢ় বাদামী বর্ণের অসম আকৃতির দাগ পড়ে। এ দাগগুলো একত্রে মিলিত হয়ে বড় দাগের সৃষ্টি করে এবং অবশেষে পুরো পাতা ঝলসে যায়। বীজ এবং বায়ুর সাহায্যে বিসত্মার লাভ করে।
ব্যবস্থাপনাঃ
রোগসহনশীল জাতের আবাদ করা (যেমন-কিরণী)। প্রতি লিটার পানির সাথে ২ গ্রাম রোভরাল-৫০ ডব্লিউ পি মিশিয়ে ১০ দিন পর পর ৩ বার সেপ্র করা বা ফসল কাটার পর পরিত্যক্ত কান্ড, মূল ও পাতা পুড়িয়ে ফেলা।
অন্যান্য করণীয়ঃ
বীজ শোধনঃ মাটি ও বীজ থেকে সুষ্ট বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধের জন্য বীজ শোধন খুব দরকারি। ভিটাভেক্স-২০০ ছত্রাকনাশক দিয়ে বীজ শোধন করা যায়। প্রতি কেজি সূর্যমুখী বীজের জন্য মাত্র ৩ (তিন) গ্রাম ভিটাভেক্স-২০০ প্রয়োজন। এটি বড় প্লাস্টিকের ঢাকনা দেয়া পাত্রে সূর্যমুখীর বীজ নিয়ে পরিমাণমতো ঔষধ মিশিয়ে পাত্রের মুখ বন্ধ করে ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে ১ দিন রেখে দেয়ার পর বীজ জমিতে বপন করতে হবে।
গাছ পাতলাকরণঃ
অতিরিক্ত গাছ থাকলে চারা গজানোর ১৫-২০ দিন পর প্রতি হিলে/গোছায় ১টি করে সুস্থ সবল গাছ রেখে বাকি গাছহুলো উঠয়ে ফেলতে হবে।
সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনাঃ
সূর্যমুখী ফসলের ফলন বেশী পেতে হলে কয়েকবার সেচ দেয়া প্রয়োজন। প্রথম সেচ বীজ বপনের ৩০ দিন পর (গাছে ফুল আসার আগে), দ্বিতীয় সেচ বীজ বপনের ৫০ দিন পর (পুষ্পস্তবক তৈরির সময়) এবং তৃতীয় সেচ বীজ বপনের ৭০ দিন পর (বীজ পুষ্ট হবার আগে) সেচ দেয়া দরকার।সূর্যমুখীর জমি সর্বদা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। জমিতে আগাছা দেখা দিলে সেটি তুলে ফেলতে হবে।
ফসল তোলাঃ
৯০-১১০ দিনের মধ্যে ফসল তোলা যায়।
বীজ সংরক্ষণঃ সূর্যমুখীর বীজ পরের মৌসুমে লাগানোর জন্য বীজ সংরক্ষণ করতে হয়। বীজ সংরক্ষণের আগে অপরিপক্ক ও ভাঙ্গা বীজ বেছে ফেলতে হবে। মোটা পলিথিন ব্যাগে বা কেরোসিন টিন বা টিনের ড্রামে বীজ সংরক্ষণ করা ভালো। ভেতরে পলিথিন দিয়ে চটের বসত্মায় ভালোভাবে শুকানো বীজ প্রতি ৩০ কেজির জন্য ২৫০ গ্রাম ক্যালসিয়াম ক্লোরাইডসহ সংরক্ষণ করলে ৭-৮ মাস পরেও বীজের শতকরা ৮০ ভাগ অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বজায় থাকে। বর্ষাকালে এক থেকে দু’বার বীজ পুনরায় রোদে শুকিয়ে নেয়া ভালো।
সূর্যমুখী তেলের উপকারিতা:
সূর্যমুখী তেল এ আছে আমাদের শরীরের জন্য আশ্চর্যজনক উপকারিতা। আসন জেনে নেই উপকারিতা গুলো। যদিও সূর্যমুখী তেলের কিছু অপকারিতাও আছে।
কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায় সূর্যমুখী তেল
সূর্যমুখীর তেলে পাওয়া ফ্যাটি অ্যাসিড ও লিনোলিক এসিড (একটি ওমেগা -৬ ফ্যাটি অ্যাসিড) এর স্বাস্থ্য উপযোগী ভারসাম্য রয়েছে। যদিও ওমেগ।-.৬ ফ্যাটি অ্যাসিড সাধারণত “খারাপ” কোলেস্টেরল হিসাবে বিবেচিত হয়, তবে শরীরের জন্য এখনও এটি অপরিহার্য। এইচডিএল বা ভাল কোলেস্টেরল (ওমেগা -৩) এবং এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টেরলের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অধিকন্তু, সূর্যমুখী তেলের মধ্যে কোনও স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে না। যার মানে এটি আসলে আপনার শরীরের সামগ্রিক কলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে পারে।
অ্যাথলেট ফুট
গবেষণায় বলা হয় যে সূর্যমুখী তেলটি অ্যাথলেট ফুট (টিনি পেডিস) চিকিৎসা করার জন্য একটি কার্যকর। অ্যাথলেট ফুট একটি পায়ের সংক্রমণ, পায়ের আঙ্গুলে সূর্যমুখী তেলের সাময়িক প্রয়োগে এই রোগ দ্রুত সেরে উঠে।
হৃদরোগের উপকার
যারা তাদের হৃদয়ের স্বাস্থ্যের উপর নজর রাখতে এবং এথ্রোসক্লেরোসিস প্রতিরোধ করতে চান তাদের জন্য সূর্যমুখী তেল একটি ভাল পছন্দ। এথ্রোসক্লেরোসিস ধমনীতে বেষ্টন করতে পারে, রক্ত চাপ বৃদ্ধি করতে পারে, এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের কষ্টের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে। কোলিন, ফেনোলিক অ্যাসিড, মনোআনস্যাচুরেটেড চর্বি এবং সূর্যমুখী তেলের মধ্যে বহুভিত্তিক চর্বি উপস্থিতি কার্ডিওভাসকুলার রোগের ঝুঁকি হ্রাস।
ইমিউন সিস্টেম উন্নত করে
সূর্যমুখী তেল ভিটামিন ই সমৃদ্ধ, যা শরীরে একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। এটা সরাসরি হৃদরোগ প্রতিরোধ এবং আপনার ইমিউন সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত।
সূর্যমুখী তেল এ আছে আমাদের শরীরের জন্য আশ্চর্যজনক উপকারিতা
ত্বকের যত্ন
সূর্যমুখী তেল, ভিটামিন ই সমৃদ্ধ, বিশেষ করে চামড়ার স্বাস্থ্য এবং পুনরায় তৈরী হওয়া কোষগুলির উন্নতির সাথে সম্পর্কিত। এটি আপনার ত্বককে সূর্যরশ্মীর ক্ষতি থেকে সুরক্ষিত রাখে। ভিটামিন ই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসগুলি বিভিন্ন ধরেনের বিষক্রিয়াকে নিরপেক্ষ করে দেয় ফলে সুস্থ কোষ ধ্বংস বা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়। দ্রুত ক্ষত নিরাময় এবং আপনার ত্বকের একটি স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। প্রসাধনী সামগ্রিতে সূর্যমুখীর তেল সাধারণত ব্যবহারের এটি একটি প্রধান কারণ।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
সূর্যমুখী তেল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পদার্থ সমৃদ্ধ। ভিটামিন ই যা টেকোফেরোল নামে পরিচিত যৌগসমূহের একটি গ্রুপ। একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার কোষকে সুস্থ কোষে রূপান্তরিত করতে পারে। বিশেষত সূর্যমুখী তেলে কোলিন এর অপস্থিতি ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই বিষয়ে আরও গবেষণা চলছে।
হাঁপানি ও আর্থ্রাইটিসের তীব্রতা হ্রাস
হাঁপানি (অ্যাস্থমা) সারা বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ লোককে প্রভাবিত করে এবং শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি করে যা জীবনের জন্য হুমকি হতে পারে। সূর্যমুখী তেল ইতিবাচকভাবে আছে এন্টি-প্রদাহী গুণগুলি যা তার ভিটামিনের উপাদান থেকে প্রাপ্ত। সেইসাথে উপকারী ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি পাওয়া যায়। হাঁপানি (অ্যাস্থমা) সহ আর্থ্রাইটিসের তীব্রতা হ্রাসে সূর্যমুখী তেল ইতিবাচক পাওয়া গেছে।
ইনফেকশন প্রতিরোধ করে
সূর্যমুখী তেলের সাধারণ ইমিউন সিস্টেমের উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে যা জীবাণু আক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং শরীরের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সূর্যমুখী তেল ঝিল্লি বাধা শক্তিশালী করে ত্বককে রক্ষা করে। যার ফলে শরীরের ভিতরে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে না। সূর্যমুখী তেল শিশুদের জন্য বিশেষ ভাবে সুপারিশ করা হয় কারণ এটি তাদেরকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। বিশেষত যখন তারা অকাল জন্ম নেয় তখন তাদের শরীর অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়।
সূর্যমুখীর বীজের মত সূর্যমুখী তেল ভিটামিন ই সমৃদ্ধ। ভিটামিন ই এছাড়াও হাঁপানি, রিমিটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। ম্যাগনেসিয়ামের সাহায্যে পেশী কমে যাওয়া প্রতিরোধ করে। টেষ্টোফ্যান মস্তিষ্ককে সতেজত করতে সাহায্য করে এবং অনিদ্রা নিরাময় করে।
আজকের দ্রুত গতির জীবনযাত্রায় ক্লান্তিকর পেশাগত জীবনের কারনে পুষ্টিকর খাদ্যগুলি যাচাই করার যথেস্ট সময় আমাদের কাছে থাকে না। তবে আমাদের রান্নাঘরে সূর্যমুখীর তেল ব্যবহার করে আমরা কমপক্ষে রান্নার মান উন্নত করতে পারি। আমরা সাধারনত যে সব খাবার খাই সেগুলি কোন প্রোটিন, ভিটামিন বা অপরিহার্য পুষ্টি প্রদান করে না। সূর্যমুখীর তেলকে আপনার খাদ্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন।
Powered by Facebook Comments