মসলা জাতীয় ফসল

ফরিদপুরে তিনশ কোটি টাকার পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের আশা

পেঁয়াজের সাদা কদম শুকিয়ে বের হয়ে কালো দানা বা বীজ; যার বাজার দর আকাশ ছোঁয়া। স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছেন ‘কালো সোনা’।

১০ বছর আগে দুই বিঘা জমিতে পেঁয়াজ বীজের চাষ করেন লাভলী আক্তার ও ইনতাজ মোল্লা দম্পতি। এরপর ভালো লাভ পেয়ে প্রতি বছরই বাড়িয়েছেন আবাদি জমির পরিমাণ। এবার তারা ৪০ বিঘা জমিতে এই পেঁয়াজের বীজের আবাদ করেছেন। যা থেকে কোটি টাকার লাভের আশা করছেন তারা। কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজে দিনবদলের এমন গল্প এখন দোলা তুলছে ফরিদপুরের ফসলি মাঠে।

চলতি মৌসুমে এ জেলায় সবমিলিয়ে পেঁয়াজ বীজের উৎপাদন ৩০০ কোটি টাকার বাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা কৃষি বিভাগের। তবে ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজের আমদানি ঠেকানো না গেলে কৃষককে মার খেতে হবে বলেও আশঙ্কা করছেন পেঁয়াজ বীজ চাষিরা।

পেঁয়াজ বীজ চাষ করে অভাবনীয় সাফল্য পাওয়া লাভলী আক্তার ও ইনতাজ মোল্লার বাড়ি ফরিদপুরের অম্বিকাপুর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে।

জানা গেছে, নুন আনতে পান্তা ফুরাতো এক সময় তাদের। কিন্তু এখন এই পরিবার কোটিপতি। নিজস্ব জমিতে তাদের পাকা ইমারতে বহুতল ভবনে যেমন জৌলুস বেড়েছে, তেমনি জীবনযাপনে এসেছে ঊর্ধ্বমুখি পরিবর্তন। দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছেলে আর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া একটি মেয়ে নিয়ে এখন তাদের ব্যয়বহুল সংসার। যা এই কালো সোনা খ্যাত পেঁয়াজ বীজের বদৌলতে তাদের কাছে ধরা দিয়েছে। প্রতি বছর তারা উপার্জনের টাকায় নিজেদের স্থাবর সম্পত্তিও বাড়াতে পারছে। নতুন করে কিনছে জায়গাজমি।

জীবন বদলে যাওয়ার মতো এই অনুপ্রেরণার গল্প জানা যায় লাভলি আক্তারের মুখেই। তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে দেখি শ্বশুর বাড়ির লোকেরা পেঁয়াজ বীজের চাষ করছেন। তিনিও স্বামীকে সহায়তায় নামেন। এতে প্রথম বছরেই ভালো আয় হয় তাদের। এরপর আর থেমে থাকেননি।’

লাভলী আক্তার বলেন, ‘আমি এই পেঁয়াজ বীজের টাকা দিয়ে ৭৫ লাখ টাকা খরচ করে বাড়িতে বিল্ডিং দিয়েছি। প্রতি বছরই নতুন জমি কিনছি। এক সময় যা ছিলো অকল্পনীয়, এখন তাই বাস্তব আমাদের কাছে।’

লাভলী আরো জানান, ‘আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার তারা বিঘা প্রতি দুই থেকে আড়াই মণ পেঁয়াজ বীজ পাবেন বলে আশা করছেন। প্রতি বিঘা জমিতে এই বীজের আবাদ করতে এক লাখ টাকারও বেশি খরচ হয়। সেই হিসাবে সবমিলিয়ে তাদের এবার প্রায় কোটি টাকার মতো লাভ থাকবে বলে তারা আশা করছেন।’

পরাগায়নের অভাবে প্রত্যাশার তুলনায় পেঁয়াজ বীজের উৎপাদনের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে ফরিদপুরের ৯টি উপজেলায় পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে এক হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে। যা থেকে প্রায় সাড়ে সাত টনের বেশি পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে সদর উপজেলায়, প্রায় ২০৮ হেক্টর জমিতে।

উল্লেখ্য, গত বছর ফরিদপুর জেলায় ১ হাজার ৮৬৭ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ করা হয়েছিল। গতবারের তুলনায় এ বছর আবাদের পরিমাণ বেড়েছে। ভালো লাভ পাওয়ায় এই ফসলের দিকে কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে। তবে এ বছর মৌমাছির অভাবে এই পেঁয়াজ বীজের গাছে পরাগায়নের মাত্রা কমে এসেছে। নিরুপায় কৃষক হাতের তালু বুলিয়ে এক ফুলের রেণুর সাথে আরেক ফুলের রেণুর পরাগায়নের পন্থাও বেছে নেন অনেক ক্ষেতে। কিন্তু এতে প্রাকৃতিক পরাগায়নের মতো ভালো ফলন হয়নি। আর তাই গত বছরের চেয়ে কিছু বেশি জমিতে চাষ হলেও এবার গতবারের চেয়ে উৎপাদন কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই সুযোগে ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজ আমদানিরও আশঙ্কা রয়েছে।

তবে কৃষকেরা জানান, ভারত থেকে পেঁয়াজ বীজ আমদানি করা হলে তা সার্বিকভাবেই ক্ষতি ডেকে আনবে। কারণ, ভারত থেকে আনা পেঁয়াজ বীজ নিম্নমানের। তাতে ভালো ফলন হয় না। পেঁয়াজ বীজ আবাদে ছোট্ট শিশু পালনের মতোই যত্নশীল থাকতে হয়। কোনো রকম অযত্ন হলে ফলন নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষেতে বীজের আবাদ শুরু হয় নভেম্বর-ডিসেম্বরে আর ফলন পাওয়া যায় এপ্রিল-মে মাসের দিকে। ক্ষেত থেকে তোলার পর এক বছর এই বীজ সংরক্ষণ করতে হয়। কারণ পরবর্তী বছরে গিয়ে কৃষকরা এই বীজটি সংগ্রহ করে ক্ষেতে বপন করে। কালো সোনা খ্যাত এই পেঁয়াজ বীজের চাষাবাদ করে জীবনের গল্প বদলে নিয়েছেন ফরিদপুরের দরিদ্র কৃষকেরা। তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করতে পেরেছেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কৃষকদের স্বার্থে কৃষকদের সুযোগ-সুবিধার দিকটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে এমনটিই প্রত্যাশা পেঁয়াজ বীজ চাষিদের।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘দাম ভালো পাওয়ায় এ বছর আমাদের লক্ষমাত্রার চেয়েও বেশি পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া ঠিক থাকলে জেলার কৃষকরা এবার সাড়ে ৭ মেট্রিক বীজ উৎপাদন করবে। আশা করা হচ্ছে, যার বাজার মূল্য কমপক্ষে ৩০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ফরিদপুর জেলার পেঁয়াজ বীজ চাষিদের সমস্যা নিরসনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর তাদের সকল ধরনের পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহায়তা করে আসছে। এতে তারা দিনে দিনে উন্নতি করতে পারছে এ সেক্টরে।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

মসলা জাতীয় ফসল

উঠছে নতুন পেঁয়াজ, ফলনে খুশি চাষি

নাটোর থেকেঃ নাটোরের চাষিরা নতুন পেঁয়াজ বাজারে তুলছেন। দাম ও ফলন দুটিই ভালো। এতে চাষিরা খুশি। সাতটি উপজেলার সহস্রাধিক চাষি
মসলা জাতীয় ফসল

খুব সহজে বস্তায় আদা চাষ করবেন যেভাবে

আদা বাংলাদেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মসলা জাতীয় ফসল। বাংলাদেশে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ২.৮৮ লক্ষ মেট্রিক টন আদা উৎপাদিত হয়।