প্রতি লোকমা ভাতে আমরা বেইমানি করি। প্রতিটি বাজেটে সরকার তাদের বঞ্চিত করে। প্রতিটি পদক্ষেপে শহরের মালিকেরা বেইমানি করেন কৃষকের সঙ্গে। যাঁরা ধান বেচা লোক, যাঁরা খাদ্যের জোগানদার, তাঁদের আলাপ জমে না টক শোতে। তাঁদের দাবিতে উত্তেজিত হয় না রাজপথ। উন্নয়ন তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যায় উড়ালসড়কে। তাঁদের সন্তানদের শ্রম বেচার ব্যবসা করে রাষ্ট্র ডলার আনে বিদেশ থেকে। তাঁদের মেয়েদের গতর খাটুনি থেকে ডলার আসে গার্মেন্ট মালিকের ঘরে। তাঁদের সন্তানেরাই ধসে মরে রানা প্লাজায়, গণকবরে শোয় থাইল্যান্ডের জঙ্গলে। কৃষকের উন্নতি আর শহরবাসী ভদ্রকুলের উন্নয়ন পূর্ব আর পশ্চিমের মতো, তাঁদের কখনো হয় না মুখ
দেখাদেখি। কেন বলছি এত কথা? বলছি কারণ, এবারও ধানের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না কৃষক। কৃষি তো একধরনের ব্যবসাও বটে। এই ব্যবসায় লাগে জমি, লাগে পানি, লাগে বীজ, লাগে খোলা আকাশের নিচে রোদে-বৃষ্টিতে হাড়ভাঙা খাটুনি। তারপর যা হয়, তা বেচতে গিয়ে কৃষক দেখেন দাম নেই। এ এক আশ্চর্য অর্থকরী জাদু—সবকিছুর দাম
বাড়ে, কমে শুধু কৃষকের ধান আর জীবনের দাম।
এবারও বোরো ধান চাষ করে লাভের মুখ দেখেননি কৃষক। দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে সারা বছরের খাটাখাটুনির
মূল্য বাদ দিয়েও নগদ টাকার যে খরচ, তা-ও উঠে আসছে না। ১০০ টাকা খরচ করে বিক্রির সময় মিলছে
মাত্র ৮২ টাকা। ধান থেকে ভুট্টা ও গমে সরে যাচ্ছেন অনেকে। গত বছরের তুলনায় ২০ হাজার
হেক্টর কম জমিতে বোরো চাষ হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি দপ্তর (প্রথম আলো, ১৮ এপ্রিল)।
কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, বোরো ধানে পানি বেশি লাগে বলে কৃষককে আমন ও আউশ চাষে উৎসাহিত
করা হচ্ছে। ধানের উপযুক্ত দাম না পাওয়ার ব্যবস্থার এটাই কি জবাব? ধান চাষে ক্রমেই বেশি থেকে
বেশি মাটির তলার পানি তোলার দরকার হচ্ছে। কারণ, নদী-বিল-খালে পানি নেই। নদীগুলো রক্ষা করা কি
উন্নয়ন নয়?
সেই উন্নয়ন হচ্ছে না বলে বিদেশ থেকে বেশি বেশি সেচ মেশিন কিনতে হচ্ছে, জ্বালানি তেল কিনতে হচ্ছে। তাতে ওসবের ডিলারদের ব্যবসা হচ্ছে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম অনেক কমলেও দেশে দাম কমে না, এতে সরকারের ভালো মুনাফা হচ্ছে। বিদ্যুতের দাম বাড়ে আর বাড়ে। তারপরও বাজার থেকে মুখ কালো করে ফেরেন কৃষক। দাম না পেয়ে রাস্তায় সবজি ঢেলে প্রতিবাদ করেন। সারের জন্য মিছিল করেন। দিনের শেষে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে গ্রামীণ অর্থনীতি। দেশে চালের দাম স্থিতিশীল রাখা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার শর্ত। চালের দাম চড়া হলে শহরবাসী খেপবে। তাই ধানের দাম কম রাখা হয়। তার ওপর আছে ধানকলের মালিক নামক মধ্যস্বত্বভোগী। সরকারিভাবে ধান-চাল কেনার ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণ করে একশ্রেণির ফড়িয়া। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা-ও আছে। এ বছরও হাওর এলাকায় বাঁধ ভেঙে হঠাৎ বন্যায় ভেসে গেছে হাজার হাজার একরের ধান। আদিম কালের হাত-পা আর বাঁশ-
বালুর বস্তা ছাড়া প্রতিরোধের কিছু নেই কৃষকের।
পানি উন্নয়ন বোর্ড আছে, হাওর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে। তারা এমন বাঁধ বানায়, যাতে প্রতিবছর ভাঙে আর যাতে প্রতিবছর বাঁধ বানানোর ব্যবসা পায় সরকারি দলের ঠিকাদাররা। তাতে আমলা-ঠিকাদার আর রড-সিমেন্ট-বালুওয়ালাদের লাভ। কিন্তু কৃষক কিসের ভরসায় আবার ফসল ফলাতে নামবেন? পাঠক, খবরের কাগজ ঘাঁটুন, গুগল বের করুন। দেখবেন প্রতিবছরই হাওরের ধান তলিয়ে যাওয়ার সংবাদ আছে। প্রতিবছরই ফসলের দাম না-পাওয়ার খবরে সয়লাব হবে আপনার কম্পিউটারের স্ক্রিন।
তারপরও কৃষক আবার জমিতে নামবেন। কৃষিকাজ কেবল তাঁর পেশা নয়, এ তাঁর জীবন, এ তাঁর ধর্ম, এ তাঁর ভালোবাসাও। কৃষকের এই গুণেই বাংলার প্রাগৈতিহাসিক ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ দূর হয়ে খাদ্যে নিরাপত্তা এসেছে। কিন্তু কৃতিত্ব যায় সরকারের ঘরে। পরিহাস হলো, যে বছর যথেষ্ট ধান, আলু, পেঁয়াজ বা আখ উৎপাদিত হয়, সে বছরও বিদেশ থেকে এসবের আমদানির অনুমতি দেয় সরকার। পাটের সুদিনও গেছে। এ এমন বাজার অর্থনীতি,
যেখানে বিদেশি খাদ্যপণ্য ব্যবসাকে সুযোগ দিতে দেশের কৃষককে ফেলা হয় অসম প্রতিযোগিতায়।
গত বছর বাম্পার ফলিয়ে আবারও বিপাকে পড়েন বোরোচাষিরা। বাজার সয়লাব ভারতীয় চালে। চালের
এ অতিরিক্ত সরবরাহের কারণে ধানের দাম কমে যাচ্ছে। তাই উৎপাদনমূল্য পাননি দেশের কৃষকেরা
(প্রথম আলো, ৪ মে, ২০১৫)। এত যুগ পরেও গরু ও গফুর একই রশিতে বাঁধা, যার নাম বেইনসাফির বাজার
অর্থনীতি। অথচ কৃষকেরাই বাংলাদেশের সত্যিকার জনক- জননী। মধ্যযুগে তাঁরাই অরণ্য, জলা ও পতিত
ভূমিতে আবাদ করে জনসমাজ পত্তন করেছিলেন। এ অঞ্চলে এক বিরাট আবাদি সভ্যতা প্রতিষ্ঠা
পেয়েছিল। সুজলা-সুফলা যে বাংলাদেশের কথা জানি, শিল্পী এস এম সুলতানের চিত্রকলায় যে সৃজনের
উৎসবের খবর আছে, তা মূলত কৃষকের অবদান।
কৃষির এ সমৃদ্ধির লোভেই পর্তুগিজ দস্যু, মারাঠা বর্গি ও ইংরেজ বেনিয়ারা বারবার বাংলায় হানা দিয়েছিল। ইংরেজ আমলের আগে জমি ও জলাভূমি কৃষকের আওতায় ছিল। ইংরেজরা এসে জমিদার শ্রেণি সৃষ্টি করে ভূমির মালিকানা তাদের হাতে তুলে দেয়। বাংলাদেশের কৃষক প্রথমবারের মতো জমির মালিকানা হারান আর প্রথমবারের মতো স্বজাতির ভেতরে বিদেশিদের দালাল শ্রেণির ক্ষমতায়ন ঘটে। গণবিরোধী উন্নয়ন ও দখলদারি ক্ষমতায়নের ফলই হলো পরাধীনতা। এই জমিদার শ্রেণি না থাকলে ইংরেজের দখল আরও আগেই উচ্ছেদ হতো।
ইংরেজের সেই শোষণকল এখনো ভিন্ন চেহারায় চালু আছে। কৃষক তবু মাটিতে উবু হয়ে সম্পদ সৃষ্টি করে
গেছেন। আর সেই সম্পদ হাতড়ে জমিদারি-দখলদারি ছাউনি কলকাতাকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা বানানোর
বদ খোয়াব দেখেছে কলোনিজাতক মধ্যবিত্ত। এরা যখন ইলাত-বিলাত করছে, কৃষককে তখন মাটি
থেকে মাথা তুলে বিদ্রোহে নেমে পড়তে হয়েছে। ইংরেজের ১১৭ বছরে ১১১টি কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল।
কেবল জমির জন্য। তেভাগা হলে ফসলের ভাগ বেশি মিলবে, পাকিস্তান পেলে জমি সব নিজেদের হবে বলে তাঁরা কখনো কমিউনিস্টদের সঙ্গে, কখনো মুসলিম লীগারদের সঙ্গে গেছেন। আমাদের সোনার বাংলার স্বপ্নেরও জনক এই কৃষক সমাজ। দিনে দিনে কৃষকের ভূমির সঙ্গে যোগ হয়েছে কৃষকের সন্তানদের মুখের ভাষার দাবি। এই ভূমি ও ভাষা রক্ষায় দাবি করা হয়েছে স্বাধীনতা। কৃষকের সন্তানদেরই তাই দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি শহীদ
হতে।
কিন্তু সংগ্রামের সোনা বেহাত করেছে ওপরতলার লোক। এদিকে ‘চাষা’ শব্দটা হয়েছে গালির সর্বনাম।
উন্নয়নের দোহাইয়ে সেই চাষার বুকে গুলি চলে কানসাটে, ফুলবাড়ীতে, রংপুরে এবং সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে। কৃষক বিদ্বেষ ছিল আমাদের পরজীবী আধুনিকতার টনিক। যেসব ফুলহাতা জামা পরা মানুষ মনে করে কৃষকের জমির দরকার নেই, ন্যায্যমূল্য পাওয়ার দরকার নেই, মনে করে শহুরে মানুষের যেকোনো দরকারে
কৃষকের জমিতে হাত দেওয়া যায়, তারা কেমন দেশপ্রেমিক? এদের এক পা দেশে আরেক পা পাশ্চাত্যে। এক বছরে ৭৬ হাজার কোটি ডলার তারা বিদেশে পাচার করে। আর ফুলবাড়ী থেকে বাঁশখালী, চিৎকার করে কৃষকের ভূমিছেঁড়া নাড়ি।
সেই ক্ষোভেই কবি কামরুজ্জামান কামু লিখেছেন,
‘তারা লাটসাহেবের
মত বাটপেরে সব
খালি রক্ত চোষার
তালে ব্যস্ত সবাই
তারা চর্বি চাটার
কাজে ব্যস্ত সবাই
তারা ইংরেজি কয়
এরা ধানখেতে রয়…
যারা ধান বেচা লোক
ছোট কুমড়া ফলায়
বড় জাংলি দিয়ে
তারা আসবে না আর
তোমাদের বাজারের
কোণাকাঞ্চিতে আর
তারা বেচবে না ধান
কোনো তিল পরিমাণ
দেশে খাদ্যেরও গান
পাখি গাইবে না আর।’
এ এমন এক দেশ হয়েছে, যেখানে ফেসবুক বন্ধ হলে তরুণেরা ফুঁসে ওঠে, কিন্তু কৃষকের পেটের মারের খবর অল্প লোকই রাখে। এ এমন এক দেশ, যেখানে রাজনীতি হয় মতবাদ, সংস্কৃতি, প্রগতি ও ধর্ম নিয়ে; কিন্তু দেশের আশি ভাগ মানুষের স্বার্থের রাজনীতি লোকাল সড়কেই আটকে থাকে। ক্ষমতার মহাসড়কে তাদের উঠতে দেওয়া হয় না। যাঁরা ধান বেচা লোক, মজলুমের নেতা মাওলানা ভাসানীর পর রাজনৈতিকভাবে তাঁরা এতিমই রয়ে গেছেন। আর আমাদের উন্নয়নও রয়ে গেছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি আমলের মতোই শহরমুখী। ঔপনিবেশিক আমলের উন্নয়ন দর্শন যদি না বদলালাম, কৃষকের ভালো না দেখলাম, তাহলে কিসের তরে আমরা স্বাধীন হলাম?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
| ২১ এপ্রিল, ২০১৬ প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখাটি এখনও কত প্রাসঙ্গিক।