মুক্তমত

কৃষিতে নারীর অবদানের প্রকৃত স্বীকৃতি নেই

|| এ. কে. আজাদ ফাহিম ||

আবহমান কাল থেকে আমাদের এই দেশ কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত। কৃষি একটি মহান পেশা। মানব সভ্যতার এই আদি পেশাতে অনেক সুপরিবর্তন এসেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, এই পেশার প্রতি লুকিয়ে নাক সিঁটকানোর একটা প্রজন্ম এখনও রয়ে গেছে। আজকের আলোচনার বিষয় যেহেতু সেটা নয় তাই সেদিকে যাবো না।

প্রতি বছরে ৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালিত হয়। এবছরও নিশ্চয় তার ব্যত্যয় ঘটবে না। এবারে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘নারীর সমঅধিকার, সমসুযোগ এগিয়ে নিতে হোক বিনিয়োগ’।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘নারী’ কবিতায় লিখেছেন,
‘সাম্যের গান গাই-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
দেশের যে খোরপোষ কৃষি আমাদেরকে এবং কৃষি পেশাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অনন্তকাল, সে গল্পের অন্তরালে নারীর অবদান কখনোই পুরুষের সমান নয়, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি! যদি কৃষি পেশাকে একটা বডি মনে করা হয়, নারী হচ্ছে তার হার্ট (হৃৎপিণ্ড)।

যে কৃষক মাঠে লাঙ্গল চালিয়ে হাল চাষ করে গেছেন। নিজে না খেয়ে সে কৃষককে খাইয়ে গেছেন কোন নারী। সে নারী কখনো মা, কখনো স্ত্রী । নিজে পেটে পাথর বেধে কৃষককে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে দূর মাঠে মাটির শানকি ভর্তি ভাতের যোগান দিয়ে তৃপ্ত থেকেছেন নারী। যদি নারীরা নিজেদের আহারকে প্রাধান্য দিতো তাহলে আজকের কৃষির অস্তিত্ব হয়তো পাওয়া যেত না।

কৃষক মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়েছে নিজের ও পরিবারের ক্ষুধার জ্বালা নিবারণের জন্য, মহাজনের ঋণ শোধবার জন্য। কিন্তু তা কি তারা পেরেছে? হয়তো পারে নি। যদিও চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কৃষানি সেখানে সবসময়ই সফল, সীমাহীন অভাবকে মাথায় নিয়েও আগামী মওসুমের বীজ সংরক্ষণ করতে ভুল করেননি। হতাশাগ্রস্থ কৃষকদের মাথায় হাত বুলিয়ে পরম মমতায় মাঠে সক্রিয় রেখেছেন নারী। রাতের আঁধারে মোনাজাতে নোনাজলে কপোল ভিজিয়ে প্রভুর কাছে ধর্না দিয়েছেন নারী। দোয়া করেছেন, স্বামী-সন্তানকে ভালো রেখো, ফসলকে রক্ষা করো, মাথার গোজার ঠাঁইকে রক্ষা করো আল্লাহ। সে আর্তনাদের কী কোন মূল্য নেই!

পুরুষের অগোচরে নারী বাড়ির আঙ্গিনায় করেছেন শাক-সবজির চাষ, হাসমুরগি পালন, করেছেন হাতের কাজ। এই অদেখা ছোট ছোট কাজগুলো কৃষিকে টিকিয়ে রাখতে অসামান্য অবদান রেখেছে। সে অসামান্য অবদান কি কোন কালে স্বীকৃতি পেয়েছিল? যুগযগান্তরে নারীর কৃষিতে অংশগ্রহণ কী পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে কোন কালে? যদি সেটা পেত তাহলে আমাদের পাঠদানে আমাদের মায়েদের পেশা গৃহিণী হিসেবে কখনো শেখানো হতো না। মায়েদের গৃহিনী পরিচয়ই নারীদের কৃষি পেশায় অংশগ্রহণকে অস্বীকার করার এক জলন্ত উদহারণ। আমার ‘মা’কে যদি কৃষক হিসেবে গণ্য করা না হয়, তাহলে জগতে আর কারোরই কৃষক হওয়ার যোগ্যতা নেই।

সর্বশেষ আদমশুমারি মতে, দেশে বর্তমান জনসংখ্যায় পুরুষ ও নারীর অনুপাত হচ্ছে ১০৬:১০০। কৃষিকাজে মোট নারীর ৭১.৫ শতাংশ নিয়োজিত আছে। যদিও এসব নারী শ্রমিকের ৭২ শতাংশই অবৈতনিক পারিবারিক নারী শ্রমিক হিসেবে কাজ করে থাকেন।

কৃষিতে নারীরা যেসব কাজ গুলো করে কৃষিকে সমৃদ্ধ রেখেছেন এবং রেখে চলেছেন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বীজ সংরক্ষণ, বীজ বাছাই, শোধন ও অঙ্কুরোদগম, বীজতলায় বীজ বপন, চারা তোলা, চারা রোপণ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, শস্য সংরক্ষণ, কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা, কৃষি শ্রমিক ব্যবস্থাপনা, জৈবকৃষি, হাঁসমুরগি পালন, ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো, গরু-ছাগল পালন, দুধ দোহন, গরু মোটাতাজাকরণ, বসতবাড়িতে শাকসবজি-ফল-ফুল চাষ, ভেষজ বৃক্ষের চাষ, কবুতর পালন, কোয়েল পালন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা, মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনা, মৌচাষ, শীতল পাটি তৈরি, অঙ্গজ বংশবিস্তার, বায়োগ্যাস কার্যক্রম, বনসাই-অর্কিড-ক্যাকটাস চাষ, খাঁচায় মাছ চাষ, পুকুরে আধুনিক উপায়ে মাছ চাষ, জ্যাম-জেলি-আচার-কেচাপ ইত্যাদি তৈরি, ভাসমান সবজি চাষ, ঘাস চাষ, উন্নত চুলায় রান্না, কুটিরশিল্প, মাশরুম চাষ, ছাদবাগান করা, জ্বালানি সংগ্রহ, কৃষি বনায়ন, সামাজিক বনায়ন প্রভৃতি।

দেশের খোরপোষ কৃষি ক্রমান্বয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে বাণিজ্যিক কৃষিতে সেখানে নারীদেরও এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হচ্ছে না। কৃষি শিক্ষায় ও কৃষি পেশাতে এখনো নারীদের অংশগ্রহণকে দেখা হয় আড়চোখে। যেখানে নারীকে পুরুষের তুলনায় অধিকার ও সুযোগ বেশি-ই দেওয়ার কথা ছিল। সেখানে তথাকথিত আধুনিকতার খোলসাবৃত সমাজব্যবস্থা কৃষিতে নারীদের পুরুষের ন্যায় সমঅধিকার এবং সমসুযোগও করে দিতে পারেনি। কৃষিতে নারীদের অবদান রাখার সুযোগ ক্রমশ সংকীর্ণ হচ্ছে। এতে কৃষির স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।

কৃষিকাজে নারীর যথাযথ স্বীকৃতি ও মর্যাদা দেওয়া, নারী কৃষক সংগঠন তৈরি, নারী কৃষিশ্রমিকদের কাজে সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, সরকারি কৃষি কর্মকাণ্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে কৃষানিদের অগ্রাধিকার দেওয়া এখন সময়ের দাবি।

কৃষিতে নারীর সমঅধিকার ও সমসুযোগ তৈরীতে সদিচ্ছার বিনিয়োগ ঘটুক, এই প্রত্যাশা।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

মুক্তমত

কৃষি ডিপ্লোমাধারীরা কেন উচ্চশিক্ষা বঞ্চিত হবেন?

বাংলাদেশে ১৮টি সরকারি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। আর বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে ১৬২টি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ছয় হাজারের বেশি পাস করে বের
মুক্তমত

কৃষি উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা ও বর্তমান বাস্তবতা

|| প্রফেসর ড. মু. আবুল কাসেম || গরিব হিতৈষী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম কৃষকদের দিকে নজর দেন। তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস