মুক্তমত

কৃষিবাজারে কৃষক কোথায়? – শাইখ সিরাজ

২০০৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চ্যানেল আইতে শুরু করি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানটির প্রথম পর্বের বিষয়বস্তু ছিল কৃষি ফসলের বাজারে কৃষকের অবস্থান জানার চেষ্টা। ভোরবেলা, তখনো সূর্যের দেখা মেলেনি, নরসিংদীর বেলাব বাজারে কৃষকের কাছ থেকে কিনে সবজি স্তূপ করে রাখা হচ্ছিল। ধীরে ধীরে বাড়ছিল বাজারে সবজির পসরা। ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটোসহ শীতের নানা সবজি। হাঁক ডাকছেন পাইকারি বিক্রেতারা। ফুলকপি স্তূপের এক বিক্রেতার কাছে জানতে চাইলাম, কী দরে বিক্রি হচ্ছে ফুলকপি। একজন বললেন, প্রতি পিস ১০ টাকা করে। বাজার ছেড়ে মিনিট দুই হেঁটে গেলাম পাশের এক সবজি খেতে। সেখানে চলছিল ফুলকপি তোলার কাজ। এক কৃষানি ফুলকপি তুলে জমা করছিলেন খেতের পাশেই। তার কাছে জানতে চাইলাম, কী দরে বিক্রি করছেন ফুলকপি? কৃষানি জানালেন, ৩ টাকা পিস। বললাম, আপনার কাছ থেকে ৩ টাকা দরে কিনে বাজারে তো ১০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। মাঝের ৭ টাকা গেল কই? কৃষানি আবেগহীন কণ্ঠে জানালেন, ‘দালালে খাইলো।’

কৃষি সাংবাদিকতা শুরুর সেই গত শতকের আশির দশক থেকে দেখে এসেছি আমাদের দেশের সাধারণ কৃষক শুধু উৎপাদক। তারা বাজার বোঝেন না, বোঝেন না বাজার অর্থনীতির জটিলতা। তারা দালালের এ লাভটাকে খারাপ চোখে দেখেন না। তারা মনে করেন, দালালরা না থাকলে তাদের পক্ষে বাজারে নিয়ে কৃষিপণ্য বিক্রি করাটা কঠিন হতো। যাই হোক, মাঠের কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে আবার ফিরলাম বেলাব বাজারে। গিয়ে দাঁড়ালাম আগের সেই ফুলকপির স্তূপের কাছে। গিয়ে দেখি ফুলকপির বাজার মূল্য ততক্ষণে ১৫ টাকা পিস হয়ে গেছে। এরই মাঝে তিন হাত বদল হয়ে গেছে। অথচ স্তূপের ফুলকপি স্তূপেই আছে। ব্যাপারটি দেখে বিস্মিত হলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই প্রতি ফুলকপির মূল্য ১৮ টাকা ছাড়াল। ফুলকপির দাম বাড়ছে কেমন করে? জানতে চাইলে, মধ্যস্বত্বভোগীরা বলছেন, খরচ আছে না! গাড়ির খরচ, লেবার খরচ, বাজার খরচ! অথচ ফুলকপি কোথাও নড়ছে না। জায়গাতেই পড়ে আছে। ঘণ্টা দুয়েক পর ফুলকপি ২০ টাকা দামে উঠে ট্রাকে চড়ল। আমরা সেই ট্রাক অনুসরণ করে কারওয়ান বাজার অবধি এলাম। ফুলকপি ট্রাকেই থাকল ঘণ্টাখানিক। কিন্তু এর মাঝেই সেই ফুলকপির দাম কয়েক হাত বদলে পৌঁছে গেছে ২৭ টাকায়। শেষে ফুলকপি ট্রাক থেকে নামল। সেখান থেকে ফুলকপি ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হলো শহরের বিভিন্ন বাজারে। আমি সেই ফুলকপি শান্তিনগর কাঁচাবাজার থেকে কিনলাম ৩৩ টাকায়। কৃষকের মাঠ থেকে ৩ টাকার ফুলকপি ভোক্তার হাতে পৌঁছাল ৩৩ টাকায়। মাঝখানে অদৃশ্য অনেক হাত ৩০ টাকা নিয়ে গেল। ২০০৪ থেকে ২০২৪ ২০ বছরে এ চিত্রের খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। অদৃশ্য হাতের সংখ্যা হয়তো কমেছে; কিন্তু হাতের শক্তি বেড়েছে বহুগুণ, বহুমুখী হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের রূপ।এ কথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। এই সময়ে কৃষিতে অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটে গেছে। কৃষিতে তরুণদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, তাদের হাতে বেড়েছে কৃষিবৈচিত্র্য, বেড়েছে উৎপাদন। বাংলাদেশ ২২টি পণ্যের উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে একটি। অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। মাছ, মাংস, তরি-তরকারি, দুধ ইত্যাদি উৎপাদনেও আমাদের যথেষ্ট সাফল্য। সরকারের নীতিসহায়তায় এ অর্জন সম্ভব হয়েছে। ভর্তুকি নীতি, ঋণ নীতি, বিপণন নীতি ইত্যাদি কারণে আমাদের কৃষকরা অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। কিন্তু কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার প্রশ্নটি এখনো রয়ে গেছে। কৃষকরা উৎপাদন বাড়াচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। পাশাপাশি আরও একটি প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এত উৎপাদনের পরও ক্রয়মূল্য সাধারণ ভোক্তার হাতের নাগালে থাকছে না কেন?

বাজারে যখন কৃষি ফসলের দাম পড়ে যায় তখন শুধু কৃষকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যখন দাম বেশি থাকে তখন কৃষক সেই অর্থে তেমন লাভবান হয় না।

কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি আর ভোক্তার ন্যায্যমূল্যে পণ্য না পাওয়ার মূল কারণ ত্রুটিপূর্ণ কৃষিপণ্য সরবরাহ চেইন। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা বেশ জটিল। কোথাও কোথাও বাজারে এত লেয়ার যে সেগুলোকে একটি চেইনে নিয়ে আসা দুরূহ একটি ব্যাপার। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় কৃষক কখনোই ঢুকতে পারেনি। মনে পড়ে ২০২২ সালে নেদারল্যান্ডসের ভেনলো সবজি প্রসেসিং অঞ্চল ঘুরে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। কৃষকের উৎপাদিত কৃষিপণ্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার ভ্যানে করে প্রসেসিং সেন্টারে আসে। সেখানে ইন্টারনেটে অকশন হয়। কৃষক নিজের মোবাইল ফোনে দেখতে পারে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যটি কত দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রসেসিং প্রতিষ্ঠান নিজের পার্সেন্টেজ রেখে বাকি টাকা পৌঁছে দেয় কৃষকের অ্যাকাউন্টে। বিষয়টি স্বচ্ছ এবং সুন্দর। এর মাঝে কোনো অদৃশ্য হাত নেই।

বাজার ব্যবস্থায় কৃষককে ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য, ফসল সংরক্ষণ সুবিধা না থাকা, চাঁদাবাজি, আমদানিকারকদের কারসাজি এবং সিন্ডিকেট এমন বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। কোথাও কোথাও কৃষকের জন্য সাপ্তাহিক খুচরা বাজারের আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে ভোক্তা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনার সুযোগ পাচ্ছেন। উদ্যোগটি ভালো। কিন্তু বিপুলসংখ্যক কৃষককে এর সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না। প্রতিটি কৃষকের পক্ষে এমন খুচরা বিক্রেতা হওয়া সম্ভব না। এতে কৃষি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে উৎপাদনব্যবস্থা। কৃষককে যুক্ত করতে হবে সহজ স্বচ্ছ একটি বাজার ব্যবস্থাপনায়।

মনে পড়ে, ২০১৮-২০১৯ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সলিডারিডা নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থায়নে খুলনা ও যশোরে দুটি কৃষিপণ্যের বাজার স্থাপন করেছিল। তাদের কার্যক্রম সে অর্থে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারেনি। এখানো বোধকরি অদৃশ্য কোনো শক্তি, এই সিস্টেমটিকে সচল হতে দেয়নি। আগামীর কৃষি অর্থনীতিতে দেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে শিগগিরই আমাদের কৃষিকে চলতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কৃষির পথে। তার জন্য প্রস্তুত করতে হবে কৃষককে, প্রস্তুত করতে হবে কৃষিপণ্যের বাজার। আন্তর্জাতিক বাজারের পাশাপাশি উন্নত করতে হবে দেশীয় বাজার ব্যবস্থাপনা। কৃষকের জন্য বাজার ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ হলে লাভবান হতো ভোক্তাও। এত দিন কৃষক ঠকেছে। ভোক্তা টের পায়নি। এখন মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এত বেড়েছে যে, পুরো সিস্টেমটাকে অকেজো করে দিয়ে কেটে নিচ্ছে সাধারণ মানুষের পকেট।

দেশের বিভিন্ন জায়গায় বাজার ব্যবস্থাপনার নতুন কাঠামো তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে উচ্চমূল্যের ফল-ফসলের ক্ষেত্রে। দেখেছি নওগাঁর সাপাহারের ড্রাগন ফল চাষি আবুল কালাম আজাদের বাগান থেকেই পাইকারি ক্রেতারা ড্রাগন ফল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। মাগুরায় দেখেছি কৃষকের বাড়ি থেকে শিম পাইকারি ক্রেতাদের কিনে নিতে। তবে সব ক্ষেত্রে এমনটি হচ্ছে না। আর এভাবে ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। এখনো পাইকারের ধরে দেওয়া দামেই কৃষককে বিক্রি করতে হচ্ছে। যেমন- আবুল কালাম আজাদ বলছিলেন তিনি বাগান থেকে যে দামে ফল বিক্রি করেন, খুচরা বাজারে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি দামে বিক্রি হয়। 

একটি টেকসই স্বচ্ছ বাজার কাঠামো তৈরি করা খুব একটা কঠিন কাজ না। সরকার ইতোমধ্যে ডিজিটালাইজড পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। একটা অবকাঠামো তৈরি হয়ে আছে। প্রয়োজন একটা পরিকল্পিত নীতিমালা আর তা বাস্তবায়নে সত্যিকারের কার্যকর উদ্যোগ। তার আগে শর্ষের ভূত চিহ্নিত করে, তা থেকে ভূত তাড়াতে হবে। না হলে ভূতেই সাবাড় করে দেবে সব উন্নয়ন।

লেখক : কৃষি সাংবাদিক ও কৃষি উন্নয়ন কর্মী।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

মুক্তমত

কৃষিতে নারীর অবদানের প্রকৃত স্বীকৃতি নেই

|| এ. কে. আজাদ ফাহিম || আবহমান কাল থেকে আমাদের এই দেশ কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত। কৃষি একটি মহান
মুক্তমত

কৃষি ডিপ্লোমাধারীরা কেন উচ্চশিক্ষা বঞ্চিত হবেন?

বাংলাদেশে ১৮টি সরকারি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট রয়েছে। আর বেসরকারি পর্যায়ে রয়েছে ১৬২টি। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ছয় হাজারের বেশি পাস করে বের