সাহিত্য ও মননশীলতা

কাজী নজরুলের মাধ্যমে যেভাবে জনপ্রিয় হলো ইসলামি সঙ্গীত!

|| জনি হোসেন কাব্য ||

তখন বাজারে ট্রেন্ড চলছিল শ্যামা সঙ্গীতের। শ্যামা সঙ্গীত গেয়ে সবাই রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছেন। এই স্রোতে গা ভাসাতে গিয়ে অনেক মুসলিম শিল্পীও হিন্দু নাম ধারণ করেন। যেমন তৎকালীন বিখ্যাত শিল্পী মুনশী মোহাম্মদ কাসেম হিন্দু নাম ধারণ করে হয়ে যান ‘কে. মল্লিক’, তালাত মাহমুদ হয়ে যান ‘তপন কুমার’। মুসলিম নামে হিন্দু সঙ্গীত গাইলে গান চলবে না বলেই তারা এমনটি করেন বলে জানা যায়।

তৎকালীন গানের বাজারের যখন এই অবস্থা তখন সুর সম্রাট আব্বাসউদ্দীন বাংলায় ইসলামি গান করার আবদার করেন নজরুলকে। তা শুনে আব্বাসউদ্দীনকে তিনি বললেন, ‘আগে দেখো ভগবতী বাবুকে রাজি করাতে পারো কিনা।’ ভগবতী বাবু ছিলেন গ্রামোফোনের রিহার্সেল-ইন-চার্জ। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আব্বাসউদ্দীন ভগবতী বাবুকে রাজি করালেন।

তারপর কাজী নজরুল ইসলাম আধাঘণ্টার সাধনায় লিখে দিলেন-
‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।’
গান লেখার দুই মাস পর রোজার ঈদ। চারদিনের মধ্যে গানের রেকর্ডিং শুরু হলো। রিলিজের অল্প কয়দিনের মধ্যেই গানটির হাজার হাজার রেকর্ড বিক্রি হয়। ভগবতী বাবুও দারুণ খুশি। একসময় তিনি ইসলামি সঙ্গীতের প্রস্তাবে একবাক্যে ‘না’ বলে দিতেন, পরে তিনিই নজরুল-আব্বাসকে বলেছেন, ‘এবার আরো কয়েকটি ইসলামি গান গাও! ‘ শুরু হলো নজরুলের রচনায় আর আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে ইসলামি গানের জাগরণ। বাজারে এবার নতুন ট্রেন্ড শুরু হলো ইসলামি সঙ্গীতের। এই ট্রেন্ড শুধু মুসলমানকেই স্পর্শ করেনি, স্পর্শ করেছে হিন্দু শিল্পীদেরও।

একসময় মুসলিম শিল্পীরা শ্যামা সঙ্গীত গাইবার জন্য নাম পরিবর্তন করে হিন্দু নাম রাখতেন। এবার হিন্দু শিল্পীরা ইসলামি সঙ্গীত গাইবার জন্য মুসলিম নাম রাখা শুরু করলেন। ধীরেন দাস হয়ে যান গণি মিয়া, চিত্ত রায় হয়ে যান দেলোয়ার হোসেন, গিরিন চক্রবর্তী হয়ে যান সোনা মিয়া, হরিমতি হয়ে যান সাকিনা বেগম, সীতা দেবী হয়ে যান দুলি বিবি, ঊষারাণী হয়ে যান রওশন আরা বেগম। তবে বিখ্যাত অনেক হিন্দু শিল্পী স্ব-নামেও নজরুলের ইসলামি সঙ্গীত গেয়েছেন। যেমন: অজয় রায়, ড. অনুপ ঘোষাল, আশা ভোঁসলে, মনোময় ভট্টাচার্য, রাঘব চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

বলা হয়, কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামি গান লেখার সহজাত প্রতিভা ছিল। খাতা-কলম দিয়ে যদি কেউ বলত, একটা গান লিখুন। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই তা লিখে ফেলতেন।

একদিন শিল্পী আব্বাসউদ্দিন অনেক খোঁজাখুজি করে নজরুলকে না পেয়ে সকালে তার বাসায় চলে গেলেন। বাসায় গিয়ে দেখলেন নজরুল গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন লিখছেন। নজরুল ইশারায় আব্বাসউদ্দিনকে বসতে বললেন । আব্বাসউদ্দিন অনেকক্ষণ বসে থাকার পর জোহরের নামাজের সময় হলে তিনি উসখুস করতে লাগলেন। নজরুল বললেন, ‘কী, তাড়া আছে, যেতে হবে?’
আব্বাসউদ্দিন বললেন, ‘ঠিক তাড়া নেই, তবে আমার জোহরের নামাজ পড়তে হবে। আর এসেছি একটা ইসলামি গজল নেবার জন্য। গজল না নিয়ে আজ যাওয়া হচ্ছে না।’ বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে নজরুলকে পাওয়া যেত না, তাই সবাই এইভাবে লেখা আদায় করত!
নামাজ পড়ার কথা শুনে নজরুল তাড়াতাড়ি একটি পরিষ্কার চাদর তার ঘরের আলমারি থেকে বের করে বিছিয়ে দিলেন। এরপর আব্বাসউদ্দিন যথারীতি জোহরের নামাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল তাঁর হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নাও, তোমার গজল’। গজলটিই হলো-
‘হে নামাজী আমার ঘরে নামাজ পড় আজ/
দিলাম তোমার চরণ তলে হৃদয় জায়নামাজ…’

কাজী নজরুল ইসলাম বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর রচিত নাতে রাসূলের জন্য। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অনেক গজল বা গান রচনা করেছেন, যা আজো হৃদয়ে দোলা দেয়, স্নিগ্ধ হয়ে যায় চৈতন্যের চোরাগলি। এমনই কয়েকটি গজরের উল্লেখ করা হলো-

১. ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়
আয় রে সাগর আকাশ-বাতাস দেখবি যদি আয়…

২. মুহাম্মদ নাম জপেছিলি, বুলবুলি তুই আগে,
তাই কি রে তোর কন্ঠের গান, এমন মধুর লাগে…

৩. আমি যদি আরব হতাম মদীনারই পথ
আমার বুকে হেঁটে যেতেন, নূরনবী হজরত…

৪. হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে যায়।
সে যে আমার কামলিওয়ালা, কামলিওয়ালা।’

কাজী নজরুল ইসলামের এ সমস্ত ইসলামি গান আজ শুধু গজল হয়ে থাকেনি, হয়ে ওঠেছে মুসলিম মানসের প্রতিভাত স্বরুপ। হয়ে ওঠেছে আরাধনার এক মূতমান হৃদস্পন্দন। পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা । গানগুলো রচনার প্রায় নব্বই বছর হয়ে গেলেও আবেদন যেন একটুও কমেনি বরং বেড়েই চলছে উত্তরোত্তর। আজও মানুষ গুনগুনিয়ে গানগুলো গায়।

বাংলায় ইসলামি গানের যে নবজাগরণ কাজী নজরুল ইসলাম সূচনা করিয়ে যে পথ দেখিয়েছেন, পরবর্তীতে সেই পথের পথিক হয়েছেন জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, গোলাম মুহাম্মদ, মতিউর রহমান মল্লিক এবং হাল-আমলের অনেকেই।

✪ জনি হোসেন কাব্য’র ‘জনপ্রিয় লেখকদের অদ্ভুত কাণ্ডকাহিনি’ বইটি থেকে নেওয়া।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

সাহিত্য ও মননশীলতা

নরম মনের মেয়ে – শাহ পারভেজ

আমার নানি ভিষণ রকম নরম মনের মেয়ে,কেউ ফেরেনি দুঃখ নিয়ে নানির কাছে যেয়ে। কেউ হয়নি হতাশ কভু নানির কটু কথায়,নানির
সাহিত্য ও মননশীলতা

তুমি আছো মিশে – শাহ পারভেজ

কে বলে তুমি নেই?তুমি আছো মিশে পুরো লাল সবুজেই। মিশে আছো ঘাসের শিশিরেবিহগের কিচিরমিচিরেভোরের সোনালী আভায়তুমি আছো মিশে পুরো বাংলায়।