দেশদেশান্তর

কৃষক থেকে ভোক্তা : পথে দাম বাড়ে কয়েকগুণ

|| সাইফুল মাসুম ||

রোজা এলেই বেগুনের কদর বাড়ে। এবারও বেড়েছে—চাহিদা ও দাম দুটিই। এখন কিছুটা কমে এলেও রাজধানী থেকে শুরু করে মফস্বলের বাজারেও মোটামুটি চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে বেগুন। তারপরও কপাল চাপড়াতে হচ্ছে বেগুনচাষিদের। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে কৃষক পর্যায়ের পাইকারি মোকামে বেগুনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৫-৭ টাকায়।

বেগুনের মতোই অবস্থা লাউ, মুলা, টমেটোসহ আরও কয়েকটি সবজির। স্থানীয় পর্যায়ে পাইকারিতে দাম একেবারে পড়ে গেছে। যদিও তার প্রতিফলন নেই খুচরা বাজারে। সবজি উৎপাদনকারী অন্যতম কয়েকটি জেলা এবং ঢাকার পাইকারি আড়ত ও খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, দাম এক লাফে কয়েক গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে খুচরা ব্যবসায়ীদের হাতে এসে। সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থায় কৃষক সর্বস্বান্ত হলেও, যথারীতি ভুগছে কিনে খাওয়া মানুষ।

জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে একদিকে কৃষক ঠকছে, অন্যদিকে ভোক্তাদের পকেট কাটা হচ্ছে।’

রাজধানীর অন্যতম বড় সবজির আড়ত কারওয়ান বাজার। গতকাল সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েক শ লাউ নিয়ে বিক্রির অপেক্ষায় বসে আছেন পাইকারি ব্যবসায়ী সোহেল। তিনি জানান, পঞ্চগড় থেকে চার হাজার লাউ এনেছেন বিক্রির জন্য। দুই দিন বিক্রি করার পরও এখনো কয়েক শ লাউ রয়ে গেছে। সোহেল বলেন, প্রতিটি লাউ গড়ে ৭ থেকে ১০ টাকা দামে বিক্রি করছেন।

কিন্তু তার থেকে ১০ গজ দূরত্বে একই আকারের ও মানের লাউ খুচরায় প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা দামে। কারওয়ান বাজার থেকে ৭-৫ কিলোমিটার দূরে মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজার ও বনশ্রী কাঁচাবাজারে দাম যাচ্ছে আরও বেড়ে। ওই দুই বাজারে প্রতিটি লাউ গতকাল বিক্রি হয়েছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।

একইভাবে কারওয়ান বাজারে গতকাল পাইকারিতে প্রতি কেজি বেগুন ১০-১৫ টাকা, টমেটো ১৫-২০, মুলা ১০-১২ টাকা দামে বিক্রি হয়েছে। মগবাজারের ডাক্তার গলির ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা আবুল কালাম এসেছিলেন কারওয়ান বাজারে সবজি কিনতে। সেখানে তিনি বলেন, পাইকারি কেজিপ্রতি ১৮ টাকা দামে বেগুন কিনেছেন। ভ্যানে করে ডাক্তার গলিতে ৫০ টাকা দামে বিক্রি করবেন। অর্থাৎ প্রতি কেজি বেগুনে তিনি লাভ করবেন ৩২ টাকা। এত বেশি দামে বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর দাবি, ‘পরিবহন খরচ, পুলিশের চাঁদা, ভ্যান ভাড়া বাদ দিলে বেশি লাভ থাকে না।’

কারওয়ান বাজার থেকে বেরিয়ে মোহাম্মদপুরের টাউন হল কাঁচাবাজারে গিয়ে বোঝা যায় দাম কীভাবে বাড়ছে। সেখানকার সবজি বিক্রেতা আজিজুল জানান, টমেটো ৮০ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, মুলা ৪০ টাকা কেজি ও লাউ প্রতিটি ৭০ টাকায় বিক্রি করছেন।

খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশি লাভ করার কারণে ভোক্তাদের বাড়তি দামে সবজি কিনতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন কারওয়ান বাজারের দয়াল ভান্ডার আড়তের মালিক আলাউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘বেগুন কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকায় এবং লাউ ৭-৮ টাকায় বিক্রি করেছি। পাইকারি দাম অনেক কমলেও খুচরা ব্যবসায়ীদের অতি লোভের কারণে খুচরায় কমেনি।’ 

তবে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন মনে করেন, পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে দামের পার্থক্যের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাঁর দাবি, খুচরা ব্যবসায়ীদের পাইকারি পণ্য কেনার পর দোকান ভাড়া, চাঁদা, শ্রমিকের বেতনসহ অনেক খরচ হয়। এ ছাড়া কাঁচামালের ৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। খুচরা বিক্রি করতে গিয়ে পাইকারিতে কেনা পণ্যের ওজন মেলে না। হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘খুচরা ব্যবসায়ীর তো বেশি লাভ না করলে পোষাবে না। মানবিকভাবেই বিষয়গুলো দেখতে হবে।’ 

কম দামে সবজি বেচে লোকসানে কৃষক
খুচরা আর পাইকারিতে যে দামে সবজি বিক্রি হচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে কৃষকেরা তা-ও পাচ্ছেন না। বগুড়া ও লালমনিরহাট প্রথম রমজানে পাইকারি দামে বেগুন কেজিপ্রতি ৫০ টাকা বিক্রি হলেও ৬-৭ রমজান থেকে দরপতন। খেত থেকে বেগুন সংগ্রহ করতে শ্রমিকের খরচই উঠছে না চাষিদের। 

লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কুমড়িরহাট এলাকার কৃষক আজিজার রহমান জানান, তিন মণ (১২০ কেজি) বেগুন পাইকারি বিক্রি করে পেয়েছেন ২৪০ টাকা। 

যশোরের পাইকারি সবজির মোকাম সদর উপজেলার বারীনগরে গতকাল প্রতি কেজি বেগুন ৫ থেকে ৬ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। 
ঝিনাইদহের পাইকারি ও খুচরা সবজি বাজার ঘুরে দেখা যায়, পাইকারিতে লাউ প্রতিটি ১০ টাকা বিক্রি হলেও তা স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। বেগুন পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকা। সেই একই বেগুন স্থানীয় খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কেজি। পাইকারি বাজারে সবজি বিক্রি করতে আসা কৃষক আব্দুর রহমান, প্রান্ত মিয়া ও টিটুল হোসেন জানান, ‘ব্যাপারী, ফড়িয়া, খুচরা বিক্রেতাদের জন্য আমরা সবজির ন্যায্যমূল্য পাচ্ছি না।’

পাবনার ঈশ্বরদীর আওতাপাড়া গ্রামের চাষি জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিটি লাউ পাইকারি বিক্রি করছি ১০ টাকা। অনেক সময় তারও কমে বিক্রি করতে হয়। কারণ, আমাদের তো উপায় নেই। পাইকাররা যে দাম বলে, তার বেশি বিক্রি করব কোথায়?’
ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘দামের এমন তারতম্য খারাপ পরিস্থিতির পূর্বাভাস। কৃষক যদি ন্যায্য দাম না পান, তাঁরা উৎপাদন কমিয়ে দেবেন। তখন সংকট আরও ঘনীভূত হবে।’ 

| আজকের পত্রিকা’র সৌজন্যে প্রকাশিত।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

দেশদেশান্তর

অ্যাডাস্ট প্রথমআলো বন্ধুসভার উদ্যোগে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত

অতীশ দীপঙ্কর ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি প্রথম আলো বন্ধুসভার উদ্যোগে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক কর্মশালা ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ রোজ:সোমবার
দেশদেশান্তর

সিলেটে বিশ্ব নদী দিবস উদযাপন

নদ-নদী রক্ষায় ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সিলেটে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্ব নদী দিবস উদযাপন করা হয়েছে। এ উপলক্ষে ২৪ সেপ্টেম্বর