চলমান কৃষি

বাংলাদেশের পঞ্চব্রীহি ও চীনের বহুবর্ষজীবী একই ধান নয়

অনেকে চীনের বহুবর্ষজীবী ধান পিআর২৩-এর সাথে বাংলাদেশের মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় আবিস্কৃত আবেদ চৌধুরীর পঞ্চব্রীহি ধান গুলিয়ে ফেলছেন। পঞ্চব্রীহি ধান প্রতিবছরে একই গাছ থেকে পাঁচবার ফলন দেয়। অন্যদিকে পিআর২৩ বছরে দু’বার ফলন দেয়। পঞ্চব্রীহি ধান থেকে প্রতিবছর হেক্টরপ্রতি ২০ টন করে ফলন পাওয়া যায়; যেখানে পিআর২৩ হেক্টরপ্রতি আট টন ফলন দেয়। পঞ্চব্রীহি থেকে দ্বিতীয়বার ফলন পাওয়ার পর তৃতীয়বারে যে ফলন হয় তা প্রথমবারের থেকেও বেশি। এভাবে চতুর্থ ও পঞ্চমবারে আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। অন্যদিকে পিআর২৩-এর ফলন চতুর্থ বছরে কিছুটা কমে যায়।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী জাকিয়া বেগম এর লেখা থেকে বহুবর্ষজীবী ধান পিআর২৩ সম্পর্কে কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো।

ইউনান ইউনিভার্সিটির (চীন) গবেষকরা আফ্রিকার একটি বন্য বহুবর্ষজীবী জাতের সঙ্গে বার্ষিক জাতের ধান ওরিজা স্যাটিভা ‘ক্রসব্রিড’ করে পিআর২৩ নামে বহুবর্ষজীবী ধানের একটি জাত উদ্ভাবন করেছেন। বহুবর্ষজীবী ধান পিআর২৩-এর বিশেষত্ব হলো, এটি চার বছরে টানা আটটি ফসল ফলাতে পারে। অর্থাৎ প্রতিবছর দু’বার করে ফসল পাওয়া যাবে। যদিও চতুর্থ বছরে এর ফলন কিছুটা কমে যায়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এটি একটি টেকসই ফসল হিসেবে গণ্য হবে। কেননা, প্রতিবার ধান চাষ করতে যে বীজ, পানি, সার, রাসায়নিক ও শ্রমের দরকার হয়- সেগুলোর খরচ কমিয়ে আনবে। যদিও ফসলটি বহুবর্ষজীবী হওয়ায় প্রতিবার আগাছা পরিস্কার করার একটা ব্যাপার থেকে যাবে। পরিবেশগত দিক থেকেও এর ভূমিকা অনেক। কারণ, ধান উৎপাদনে যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়, তা অনেকাংশে কমিয়ে আনবে। তার ওপর এই ধানগাছের শিকড় প্রতিবার বৃদ্ধি পেয়ে প্রশস্ত হয়। যার ফলে শিকড়ের পানি ধারণক্ষমতা অনেক বেড়ে যায়, পাশাপাশি মাটির সংরক্ষণও হয়। কেননা, বহুবর্ষজীবী মাটির ক্ষয় কমায়। কারণ, গাছপালা বহু বছর ধরে বেড়ে ওঠার জন্য রেখে দেওয়া হয়। এভাবে খামার সরঞ্জাম দ্বারা কম যান্ত্রিক ব্যাঘাত ঘটে। পিআর২৩ অন্যান্য ধানের তুলনায় হেক্টরপ্রতি ৬.৮ টন ফলন দেয়। ২০২১ সালে দক্ষিণ চীনের ৪৪ হাজারের বেশি কৃষক এই জাত চাষ করেছিলেন।

২০২২-এর নভেম্বরে নেচার সাসটেইনেবিলিটি জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল অনুসারে, চার বছর ধরে বহুবর্ষজীবী ধান চাষের ফলে উল্লেখযোগ্য পরিবেশগত উপকারিতা পাওয়া যায়। যেমন- মাটিতে এক টন জৈব কার্বন (প্রতি হেক্টর প্রতিবছরে) জমা হয়, পাশাপাশি মাটির পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বহুবর্ষজীবী জাতগুলো কৃষকদের কাছে এখন খুবই পরিচিত। কারণ, এটি প্রতিটি পুনর্বৃদ্ধি চক্রে ৫৮ শতাংশ শ্রম ও ৪৯ শতাংশ অন্যান্য উৎপাদন খরচ সাশ্রয় করে। গবেষকরা দাবি করেন, এটি জীবিকার মান উন্নত করে, মাটির গুণমান বৃদ্ধি করে এবং অন্যান্য শস্যের ওপর গবেষণাকে অনুপ্রাণিত করে কৃষিকে রূপান্তরিত করতে পারে।

১৯৭০-এর দশকে একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর, ইউনান একাডেমিতে ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বহুবর্ষজীবী ধানের কাজ শুরু হয়। ১৯৯৫ ও ২০০১-এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি প্রকল্প শুরু করেছিল, যেখানে চীনের একজন তরুণ মাস্টার্সের ছাত্র ফেঙ্গি হু বহুবর্ষজীবী ধানের প্রজননে কাজ করেছিলেন। তহবিল অভাবের কারণে ২০০১ সালে প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু পিএইচডি শেষ করার পর হু ইউনান ইউনিভার্সিটিতে দ্য ল্যান্ড ইনস্টিটিউট, কানসাস, ইউএস-এর সহায়তায় গবেষণা চালিয়ে যান। প্রথম জাতটি ২০১৮ সালে চীনা চাষিদের কাছে প্রকাশ করা হয়েছিল।

২০১৮ সালে ইউনান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা অবশেষে পিআর২৩ বাণিজ্যিক-গ্রেড বহুবর্ষজীবী ধানের জাত তৈরি করেছেন। গবেষণাকারী দলটি ইউনান প্রদেশ জুয়ে খামারগুলোতে বার্ষিক ধানের পাশাপাশি পিআর২৩-এর কর্মক্ষমতা অধ্যয়ন করতে পাঁচ বছর ব্যয় করেছে। নানা কারণে পঞ্চম বছরে ফলন কমতে থাকে। এর ফলে গবেষকদের চার বছর পর বারোমাসি ধান ফের বপনের জন্য পরিচালিত করেছিল।

২০২১ সালে গবেষকরা জানিয়েছেন যে প্রাথমিকভাবে ৩ হাজার ৬৪২ হেক্টর খামার থেকে, এরই মধ্যে প্রায় ১৫ হাজার ৩৭৮ হেক্টর জমিতে পিআর২৩ ধান লাগানো হয়েছিল। গবেষকদের মতে, বহুবর্ষজীবী ধান চাষে প্রায় ৬০ শতাংশ কম পরিশ্রম হয় এবং বীজ, সার ও অন্যান্য উপকরণের জন্য ব্যয় করা অর্থের প্রায় অর্ধেক সাশ্রয় হয়। এই ধানের জাতের পরিবেশের ওপরও অনেক ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যেমন- বার্ষিক চাষাবাদ এড়ানো এবং মাটিতে উচ্চতর মাত্রায় জৈব কার্বন এবং নাইট্রোজেন সঞ্চিত হয়।

ধান বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার খাবারের জোগান দেয়, এর চাষ এবং ব্যবহার প্রাথমিকভাবে এশিয়ায় শুরু হয়েছিল। আজকের বেশির ভাগ ফসলই একসময় বহুবর্ষজীবী ছিল। কিন্তু এই ফসলকে বার্ষিক, স্বল্প সময়ের জন্য প্রজনন করা হয়, যাতে আরও বেশি ফলন হয় এবং দ্রুত খাদ্যের চাহিদা মেটানো যায়। বহুবর্ষজীবী ধান একটি রূপান্তরমূলক উদ্ভাবন হতে পারে যদি এটি অর্থনৈতিকভাবে টেকসই প্রমাণিত হয়।

পঞ্চব্রীহি ও পিআর২৩- এ দুটি ধানেরই উদ্ভাবন বিশ্ব কৃষিকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে। কৃষিক্ষেত্রে এজাতগুলোর ভূমিকা যুগান্তকারী ও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Avatar

চাষাবাদ ডেস্ক

About Author

You may also like

চলমান কৃষি

ইরির তত্ত্বাবধানে খাগড়াছড়িতে উচ্চ ফলনশীল ধানের বাম্পার ফলন

খাগড়াছড়ি মহালছড়ি উপজেলার পাকিজাছড়ি গ্রামে এবং সদর উপজেলার ভূয়াছড়ির নতুন বাজার গ্রামে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইরি) তত্ত্বাবধানে কম সময়ে
চলমান কৃষি

সিলেটের বিশ্বনাথে ৩ দিন ব্যাপী কৃষি মেলার উদ্বোধন

সিলেটের বিশ্বনাথে উপজেলা কৃষি অফিসের আয়োজনে ও উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় ‘কন্দাল ফসল উন্নয়ন প্রকল্প’র আওতায় ৩ দিনব্যাপী (৮-১০ মে) কৃষি