আলু সারা পৃথিবীর জনপ্রিয় খাদ্যগুলোর একটি। ভারতীয় উপমহাদেশে কখন থেকে আলু চাষ শুরু হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা মুশকিল । তবে ধারণা করা হয় যে, সতেরো শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগিজ নাবিকরা ভারতে প্রথম আলু নিয়ে আসে। ১৮৪৭ সালে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত The Gardening Monthly ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যায় ভারতে আলু চাষ সম্পর্কে প্রথম রেকর্ড দেখা যায়। শুরুর দিকে আলুর চাষ হতো কলকাতার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে, সেখান থেকে পরে আলু চাষের প্রবর্তন হয় চেরাপুঞ্জিতে। ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের গভর্নর থাকাকালীন সময়ে (১৭৭২-১৭৮৫), তাঁর উদ্যোগে আলুর চাষ বোম্বেসহ অনেক প্রদেশে বিস্তার লাভ করে।
আলু একটি তৃণজাতীয়, বর্ষজীবী ফসল; সাধারণত দু থেকে তিনটি চোখবিশিষ্ট কন্দের রোপণ খন্ড দ্বারা বংশবিস্তার করা হয়। বীজ থেকে একই জাতের হুবহু বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদ পাওয়া যায় না। কান্ড সোজা বা ভূশায়ী, লিকলিকে, কাক্ষিক-শাখাযুক্ত বা শাখাবিহীন। জাতের ওপর নির্ভর করে কান্ড গোলাকার বা কৌণিক, লোমযুক্ত বা মৃসণ, সবুজ বা ঈষৎ রক্তবর্ণযুক্ত। বিশ্বে কয়েকশত জাতের আলু চাষ হয়। এগুলির পার্থক্য বাহ্যিকরূপ, কন্দের গঠন, আকার ও বর্ণ, পরিপক্কতার সময়, রান্না ও বাজারজাতকরণ গুণাবলীর উপর ভিত্তি করে।
বিক্রমপুরে আলু চাষের জনপ্রিয়তা পায় পাকিস্তান সময়কালে। ১৯৫১-১৯৬৫ সালে সিরাজদিখান, শ্রীনগরের কিছু অংশ, টঙ্গীবাড়ী ও সদরে বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষ শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের পর আলু সংরক্ষণের জন্য এ অঞ্চলে কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ শুরু হয়। টঙ্গীবাড়ী থানার বেতকা, আব্দুল্লাহপুর ও আউটশাহী ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি কোল্ড স্টোরেজ নির্মিত হয়। পরে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের মালখানগর, রশুনিয়া; সদরের হাটলক্ষ্মীগঞ্জ ও পঞ্চসার ইউনিয়ন কোল্ড স্টোরেজ নির্মিত হয়। মূলত আলু চাষকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে শীতের মৌসুমে রংপুর, ময়মনসিংহ, বগুড়া, দিনাজপুর, নোয়াখালী, জামালপুর ও শেরপুর হতে প্রচুর মানুষ আসতো কাজ করার জন্য।
দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি নিয়ে তারা এ অঞ্চলে কাজ করার জন্য আসতেন। তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় ‘বদলী’ বা ‘পোব্বা’ বলা হতো। বিক্রমপুরের বিভিন্ন হাট বাজার হতে আলু চাষী গিরস্ত তাদের নিয়ে যেতেন কাজে। পারিশ্রমিক হিসেবে তাদের নিদিষ্ট অর্থ দিতেন। কোন কোন গিরস্ত আবার খাওয়াতেন, থাকার ব্যবস্থা করতেন আবার অর্থও দিতেন। বিক্রমপুর এ সময় ভিন্ন অঞ্চলের মানুষে সয়লাব হতো। আলু চাষে বিক্রমপুরের মানুষের ঐতিহ্য আজ নষ্ট হওয়ার পথে। গত ২-৩ বছর যাবৎ আলুর মধ্যস্থকারীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধি করে দ্বিগুণ মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তারা।
বর্তমান মুন্সিগঞ্জ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রায় ৪৪ টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষ হচ্ছে। অথচ নিত্য খাদ্য তালিকাভুক্ত এ পন্যটির দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে। কারো কাছে কোন জবাবদিহিতা নেই! বিক্রমপুর অঞ্চলে কখনো আলুর দাম এতো ছিল না খুচরা বাজারে, বর্তমান খুচরা বাজারে কেজি প্রতি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা। যা অশনী সংকেত ভবিষ্যৎ আলু বাজারের জন্য! বাজার ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন একজন সাধারণ ভোক্তা হিসেবে সত্যি ভাবিয়ে তোলে। আসুন বিক্রমপুরের পরিচিত পাওয়া এ অর্থকরী ফসলটিকে কিছু মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত থেকে রক্ষা করি…
|২৭ জুন ২০২৪ ইং, বৃহস্পতিবার |
লৌহজং, বিক্রমপুর।